শিরোনাম
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
পোড়াতে ১০, ভাঙতে ৫ হাজার

হরতাল অবরোধে গাড়ি জ্বালায় ভাড়াটে চক্র

হরতাল-অবরোধে কিছু দুর্বৃত্ত আর ভাড়াটে বোমাবাজ রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে অরাজকতায় মেতে ওঠে। হাজারো নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও ভাড়াটে বোমাবাজ-দুর্বৃত্তরা ঝড়োগতিতে রাস্তায় নেমে এলোপাতাড়ি গাড়ি ভাঙচুর চালায়, আগুনে পুড়িয়ে দেয়। রাজপথ, অলিগলি, ব্যস্ততম মার্কেট বা অন্য কোনো জনাকীর্ণ স্থানে ভাড়াটেরা জ্বালাও-পোড়াও, বোমা হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এদের দাপটে পুলিশ-গোয়েন্দারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরতাল, অবরোধ কর্মসূচির ২-১ দিন আগেই পরিচিত নেতা-কর্মীরা মহল্লা ছেড়ে এমনকি অনেকে রাজধানীর বাইরে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু নিজেদের এলাকায় দলীয় তৎপরতায় সরব থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতেই তারা ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের মাঠে নামানোর কৌশল নিয়ে থাকেন। হরতাল-অবরোধ বৃদ্ধি পাওয়ায় বোমাবাজদের কদরও বেশ বেড়ে গেছে, বেড়েছে ভাড়ার রেটও। এরা অগ্রিম পাওনা বুঝে নেয় হরতালের আগের দিন। আর হরতাল শুরুর আগেই তারা বেশ কিছু গাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, ভাঙচুর করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ন্ত্রিত এ ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের দাপট সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গত তিন মাসে আট দফা হরতাল-অবরোধে ওই চক্রের সদস্যরা অর্ধশতাধিক গাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ভাঙচুর করেছে আরও পাঁচ শতাধিক গাড়ি। বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতিই ঘটে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। অধিকাংশ ঘটনা ভাড়াটে চক্রের সদস্যরা ঘটালেও ওইসব ঘটনায় রুজুকৃত মামলায় বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীরাই আসামি হচ্ছেন। ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দশ হাজারে পুড়ে গাড়ি, ভাঙচুরে লাগে পাঁচ হাজার : মাত্র ১০-১২ হাজার টাকা হাতে পেলেই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা দিব্যি যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। আবার বাস-মিনিবাস ভেঙে চুরমার করার জন্য তাদের দাবি থাকে পাঁচ হাজার টাকা। এ ছাড়া যে কোনো জনাকীর্ণ স্থানে, ব্যস্ততম মার্কেটের সামনে, রাস্তার মোড়ে ককটেল-বোমা ফাটানোর ক্ষেত্রে দিতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।

ওরা কোনো রাজনৈতিক দলের আস্থাভাজন কর্মী নয়। সংঘবদ্ধ এ চক্রের সদস্যরা চাহিদা অনুযায়ী টাকা হাতে পেলে তাণ্ডব চালায় রাজপথে, যেখানে সেখানে ছড়িয়ে দেয় আতঙ্ক। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে তারা 'গাড়ি ভাঙা গ্রুপ' হিসেবে পরিচিত।

রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০টি ভাড়াটে চক্র তৎপর রয়েছে। প্রতি গ্রুপে আছে ১০-১২ জন করে টোকাই হিসেবে পরিচিত শিশু-কিশোর আর আছে-ঠিকানাহীন ভাসমান গোছের বেকার। সরাসরি প্যাকেজ চুক্তিবদ্ধ হয়ে তারা মাঠে নামে। সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক হরতাল-অবরোধে গাড়ি ভাঙচুরসহ আগুনে পোড়ানোর সময় রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, কোতোয়ালি ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় পৃথক অভিযানে ২৭ জন তরুণ ও যুবক গ্রেফতার হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেওয়া জবানবন্দির সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি গাড়ি পোড়ানোর সময় গুলশান লিংক রোড থেকে রফিকুল ইসলাম (৩০) নামে সংঘবদ্ধ চক্রের এক সদস্যকে হাতেনাতে আটক করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত রফিকুল ইসলাম র্যাবকে জানান, তার নেতৃত্বে একটি পেশাদার চক্র মহাখালী কাঁচাবাজার এবং গুলশান এলাকার বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পোড়ানোর মিশন চালিয়ে থাকে। তারা পেট্রল ও ম্যাচ নিয়ে টার্গেটকৃত স্থানগুলোতে অবস্থান নেয় এবং সুযোগ মতো বাস-মিনিবাসে চড়াও হয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। র্যাব-১ এর মেজর এস এম মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রফিকুলের নেতৃত্বে বিভিন্ন বস্তিতে ঠিকানাহীন ১৫-২০ জন টোকাই শ্রেণীর সদস্য রয়েছে।

কোথায় চলে কার দৌরাত্দ্য?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাততলা বস্তি এলাকায় বোমাবাজ-দুর্বৃত্তদের নেতৃত্ব দেন কুলু হানিফ ও ইকবাল। তারা বনানী, গুলশান, মহাখালীতে নানা অঘটন ঘটিয়ে থাকে। পুরান ঢাকা এলাকার এমন একটি ভাড়াটে চক্রের নাম রুবেল-আজিজ গ্রুপ। তাদের গ্রুপে রয়েছে আতাবর, নান্টু, মনির, পাপ্পু, ইব্রাহিম, পিন্টুসহ ১৫-১৬ জন। আজিজ-রুবেল গ্রুপটি সমগ্র কোর্টকাচারী এলাকা, জনসন রোড, ধোলাইখাল, ইংলিশ রোড, নবাবপুর রোড, দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পর্যন্ত এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করে থাকে।

রাজধানীর মতিঝিল, জসিমউদ্দিন রোড, কমলাপুর স্টেশনের আশপাশ এলাকায় হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা চালায় কামরুল-মাসুম-মিঠু গ্রুপ। এ গ্রুপের চিহ্নিত সদস্যরা হচ্ছে চণ্ডিবাড়ীর রুবেল, সাজ্জাদ, রাজু, দবির, রবি, নূরুসহ কয়েকজন। কমলাপুর বাজার রোড, জসিমউদ্দিন রোড, মতিঝিল শাপলা চত্বর, কমলাপুর রেলস্টেশন ও মতিঝিল কলোনি এলাকাজুড়ে তাদের একচ্ছত্র দাপট। রামপুরা ব্রিজ থেকে কুড়িল পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে অরাজকতায় মেতে ওঠে ফর্মা আব্বাস ও শাহজাহানের নেতৃত্বাধীন চার-পাঁচটি গ্রুপ।

গুলিস্তান এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও করার জন্য একাধিক গ্রুপ থাকলেও আক্তার, ব্যঙ্গা, টুন্ডা সোহেল, মিন্টুর নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে ৩০-৩৫ জন টোকাই শ্রেণীর কিশোর। টুন্ডা সোহেল জানান, স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের দুজন যুবনেতা তাদের অর্থায়ন করে থাকে। ব্যঙ্গা-টুন্ডার গ্রুপ ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে শুরু করে গুলিস্তান ট্রাফিক পয়েন্ট, সিদ্দিকবাজার নর্থ-সাউথ রোড এলাকায় নানা অরাজকতায় লিপ্ত হয়। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও সিন্ডিকেট দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি হচ্ছে উত্তর যাত্রাবাড়ী, অন্যটি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী গ্রুপ। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী গ্রুপে রয়েছে কশাই শহীদ, বেলাল, সোহাগ, ইদ্রিস, মাহবুব, ইকবাল। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ২০-২২ জন টোকাই শ্রেণীর কিশোর-তরুণ। উত্তর যাত্রাবাড়ী গ্রুপে আছে পোড়া সেন্টু, টুন্ডা বাবুল, সালাহউদ্দিন, স্বপন, মিজান, কালা শফিকসহ ২৫-৩০ জন।

বাইরের গ্রুপ বেশি বেপরোয়া

অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, ঢাকার বাইরে গড়ে তোলা চক্রগুলোই রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডবলীলা চালিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে টঙ্গীর এরশাদনগর বস্তি ও আরিচনগর এলাকায় অন্তত পাঁচটি 'ভাড়াটে গাড়ি ভাঙা গ্রুপ' রয়েছে। টঙ্গী আরিচপুর এলাকায় ভাগিনা বাবু গ্রুপের সদস্যরা এখন ভাড়াটে হিসেবে রাজধানীর তেজগাঁও, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা এলাকায় গিয়ে গাড়ি ভাঙচুরসহ জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। ওই গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড রাজু খান গণপিটুনিতে নিহত হওয়ায় এখন পুরো গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে হাকিম, আলী ও মামুন। তাদের অধীনস্থ সদস্যরা হচ্ছে_ অপু, সোলায়মান, গুঠু, ফেউ জামাল, পল্টন, জারজ সেলিম, মোবা, ঘাউরা বাতেন, রতন, সুরুজ, শিপু ও মানিক।

পুলিশের বক্তব্য

ডিএমপির ডিসি (সদর) আনোয়ার হোসেন বলেন, যারা বোমা মারছে তারা পেশাদার অপরাধী। খোলাবাজার থেকে সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে বোমা বানিয়ে অরাজকতায় জোগান দিচ্ছে। তিনি জানান, সম্প্রতি বোমাবাজদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ নির্দেশ এসেছে। একই সঙ্গে বোমার তৈরির সরঞ্জাম কোথায় কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। ডিসি জানান, বোমা নিক্ষেপকারী ও যানবাহনে অগি্নসংযোগকারীদের গ্রেফতারে জোরালো তৎপরতা চলছে। সাম্প্রতিক তিন দফার হরতালকালেই রাজধানীতে শতাধিক বোমাবাজ ও অগি্নসংযোগকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে প্রায় ৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সর্বশেষ খবর