শিরোনাম
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

আইনজীবীদের দলবাজিতে কলুষিত আদালত

নির্যাতিত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। কোথাও বিচার না পেয়ে মানুষ শেষ ভরসা হিসেবে শরণাপন্ন হয় আদালতের। সভ্য সমাজে তাই আদালতের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই আদালতের পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে কিছু দলবাজ আইনজীবীর কারণে। খবর বাংলানিউজ।

আদালতকে বিতর্কিত করলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়। আদালতের প্রতি আস্থা হারালে মানুষ হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরা আইন হাতে তুলে নেয়। এতে সমাজ হয় পশ্চাৎমুখী। আদিম উন্মত্ততায় আবার ফিরে আসে 'জোর যার মুলুক তার' নীতি। এমনটাই মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এসব কারণে আদালতের সম্মান রক্ষা করা খুবই জরুরি। এ জন্য বিচারক থেকে শুরু করে আইনজীবী, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ_ সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রত্যাশিত আদেশ না পেয়ে প্রায়ই আদালতের ওপর চড়াও হচ্ছেন আইনজীবীরা। ব্যবহার করা হচ্ছে অশালীন ভাষা। দিন দিন বাড়ছে এ প্রবণতা। পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে উদ্বিগ্ন সবাই। পুলিশ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের ওপর কর্তৃত্ব দেখায় না। বাধা দেয় না মিটিং-মিছিলে। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আইনজীবীদের এহেন কাজে বাধা দেয়নি। ফলে যে কোনো সরকারের সময়েই সরকারবিরোধী আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার থাকে আদালত প্রাঙ্গণ। আর এ সুযোগটিরই অপব্যবহার করছে রাজনৈতিক দলগুলো। কখনো খোদ আইনজীবীরাই অবতীর্ণ হচ্ছেন দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায়। মহলবিশেষের স্বার্থে আদালত বর্জন, মিছিল, এজলাসের মধ্যে স্লোগান, আইনজীবীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুরসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য ও সহিংসতা চলছে। দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে আদালত অঙ্গনকে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা নেতিবাচক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে অবস্থার ক্রমাবনতিটা সহজেই টের পাওয়া যায়। এমনকি আদালতের বাইরের রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করেও আদালত প্রাঙ্গণকে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। ২৬ নভেম্বর দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে ১৮-দলীয় জোট সমর্থিত আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের এক এজলাসে বিচার চলাকালে বাইরে বিক্ষোভ করেন। এ সময় এজলাসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলে তারা দরজা-জানালা ধরে ধাক্কাধাক্কি করেন। শোনা যায়, দরজায় লাথি মারার ঘটানাও ঘটেছে। একই দিন ঢাকার নিম্ন আদালতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহর রিমান্ড ও জামিন শুনানিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ২৮ নম্বর এজলাসের ভেতরে ও বাইরে স্লোগান দিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা। ম্যাজিস্ট্রেট পরে আদেশ দেবেন জানালে ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে অশালীন ভাষা ব্যবহার ও নানা কটূক্তি করেন তারা। ২০১০ সালের ৭ জুন দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের রিমান্ড ও জামিন শুনানিতে ঢাকার সিএমএম আদালতের এক ম্যাজিস্ট্রেটকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ ও ফাইল ছুড়ে মারেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা। ২০১০ সালের ২ আগস্ট মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে সংবিধান নিয়ে কটূক্তির শুনানিকালে হাইকোর্টের এক এজলাসে হইচই ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা। এ সময় তারা আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হন। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলাও হয়েছিল। ২০১২ সালের ২২ মে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা বিচার চলাকালে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের দরজায় লাথি মারেন, আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নাজিরের কক্ষের জানালা ভাঙচুর করেন। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছিল। বাদ যাননি আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরাও। ১৭ নভেম্বর বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মানি লন্ডারিং মামলায় খালাস পাওয়ায় বিচারকক্ষের দরজায় লাথি মারেন ও জানালার গ্লাস ভাঙচুরের চেষ্টা চালান তারা। তারা এজলাসের বাইরে স্লোগান দিতে থাকেন এবং বিচারকের উদ্দেশে গালিগালাজ করতে থাকেন। ঢাকা বারের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, আইনজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে বিচার বিভাগ নামের প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা করা। বিচার বিভাগের প্রতি আইনজীবীরা সম্মান প্রদর্শন করলে সাধারণ বিচারপ্রার্থী মানুষের আইনের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা অটুট থাকবে। আমি মনে করি না কোনো আইনজীবী এ রকম বিশৃঙ্খলা করতে পারেন। মুষ্টিমেয় কিছু আইনজীবী চেষ্টা করছেন বিচার অঙ্গনকে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের দিকে নিয়ে যাওয়ার। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত বলেও মনে করেন সিনিয়র এই আইনজীবী। ঢাকা বারের সিনিয়র আইনজীবী, সাবেক মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী বলেন, আইনজীবীরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এটি তাদের অধিকার। কিন্তু আদালত হচ্ছে একটি পবিত্র স্থান। আদালতের পবিত্রতা রক্ষায় আইনজীবীদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আদালতের সম্মান ও পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কাজ থেকে সবার বিরত থাকা উচিত। সাম্প্রতিককালের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত বলে মনে করেন তিনি। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ ধরনের কাজ কোনো আইনজীবী করতে পারেন না। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালত এ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার মামলা করতে পারেন। আদালতের প্রতি আইনজীবীদের এহেন আচরণ বিচারব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা বার শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, কোনো দলের আইনজীবীরই আদালতের প্রতি এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। এতে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাবে। বিচার বিভাগ সুদূরপ্রসারী ক্ষতির শিকার হবে। মামলার বিচারকাজ পরিচালনার সময় বিচারকদেরও জুডিশিয়াল মাইন্ড বা বিবেক প্রয়োগ করার আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা মহানগর আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আলম তালুকদার বলেন, এ প্রবণতা আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অশনি সংকেত। এসব ঘটনা যাতে কখনই আর না ঘটে সে জন্য আদালতকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার মামলা করতে পারেন। আবার যে কোনো আইনজীবীও এ মামলা করতে পারেন। একই সঙ্গে বিজ্ঞ আইনজীবীরা শুনানিতে আরও সহনশীল হবেন বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর