সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

আবার এলো বাঙালির প্রাণের বৈশাখ

আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বাংলা পঞ্জিকার হিসাব মতে চৈত্রের পর বৈশাখের শুরু। আর বরাবরের মতো পুরনোকে বিদায় জানিয়ে এবারও নতুনের বারতা নিয়ে এসেছে বৈশাখ। ১৪২১ বঙ্গাব্দের শুভযাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই অতীত হয়ে গেছে আরও একটি ঘটনাবহুল বছর। অর্জন-বর্জন, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, ঘাত-সংঘাতের নানা ঘটনায় স্মৃতির মলাটে বন্দী হয়ে গেল বছরটি। আর পহেলা বৈশাখ এসেছে যাবতীয় তিক্ততা-ব্যর্থতা-দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর বার্তা নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে বাঙালির প্রধানতম সম্প্রীতির উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। মোগল আমল থেকে যে সন গণনার উদ্ভব, সময়ের পরিক্রমায় সেই সনের শুরুটাই পরিণত হয়েছে প্রাণের উৎসবে। ষাটের দশকে এই জনপদ যখন পাকিস্তানের নিগড়ে, আইয়ুব আমলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনে যখন বাংলার উৎসব বিপন্নপ্রায়, তখনো নতুন উদ্যমে জেগে ওঠার শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে বৈশাখ। এরপর স্বাধীনতা এসেছে, ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে উৎসবের সব রং। আর সেই উৎসবের ভিড়ে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত বৈশাখ। এই উৎসব কেবল উৎসবই নয়। এটি একাধারে বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রতীকী উপস্থাপনাও বটে। বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের মানুষ বাঙালিত্বের মন্ত্রে দীক্ষিত হন আরও একবার। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার যে শিক্ষা বৈশাখ বারবার দিয়ে যায়, সেই বৈশাখই যেন শাণিয়ে দেয় জাতিসত্তা, দিয়ে যায় অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধের দুরন্ত সাহস। বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আবহমান কাল ধরে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বাংলা নববর্ষকে নিজেদের সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য হিসেবে পালন করে আসছে। কৃষিপ্রধান এই জনপদে সুষ্ঠুভাবে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন দরকার ছিল আগে থেকেই। চান্দ্র আর সৌরসনে আটকেপড়া বর্ষপঞ্জি সে চাহিদা যেন কিছুতেই মেটাতে পারছিল না। সেই চিন্তায় ভারতবর্ষে মোগল আমলে সম্রাট আকবরের সময় কার্যকর হয় 'ফসলি সন'। মূলত 'শস্যকর' আদায়ের হিসাব রাখার জন্য এই 'ফসলি সন' বা বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে সেই শস্যকর আদায়ের বর্ষপঞ্জীই এখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। সেটাই আজ বাংলা সন, বঙ্গাব্দ।

দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালিত হয়। বিশ্বের সব প্রান্তের সব বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সব দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে এখনো এ দিনটি মানুষের জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে হাজির হয়। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরে বসে বৈশাখী মেলা। প্রাণের আনন্দে উদ্বেলিত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা সেসব মেলায় অংশ নেয়। পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-ক্লেশকে ঝেড়ে ফেলে আনন্দে উদ্বেলিত হন তারা। নতুন বছরটি তাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসবে কোনো শুভ বার্তা, এ প্রত্যাশায় তারা গেয়ে ওঠেন- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...। এই উৎসব সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন- 'প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ।' সত্যিকার অর্থেই বৈশাখে 'বৃহৎ' হয়ে ওঠে বাংলার মানুষ। আজকের এই দিনে পুরো বাংলাদেশ সেজে উঠে নতুন সাজে। নতুন বছরের প্রথম দিন উদযাপন করে নতুন উদ্যমে। গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে আত্দীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। সাধ্যের শেষাংশটুকু উজাড় করে দিয়ে সাজানো হয় নতুন রূপে। গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলায় থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তি। এ দিনে অনুষ্ঠিত হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নতুন বছরকে সবাই আনন্দময় করে তোলে। গ্রামীণ জনপদের মতো করে শহরের মানুষও বৈশাখকে বরণ করে নিতে কোনো কার্পণ্য করে না। তারা ছুটে যায় পার্ক কিংবা নগরীর বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। সেখানকার অনুষ্ঠানে সপরিবারে যোগ দেয় সবশ্রেণীর মানুষ। এ দিন পান্তা-ইলিশ না খেলে যেন কোনো কিছু অপূর্ণ থেকে যায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। যদিও স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয়, সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। তবে তা এখন বটমূল নামেই সবার কাছে পরিচিত। বরাবরের মতো এবারও একই আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে বছরের প্রথম দিনে এ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। পহেলা বৈশাখ সকালবেলায় চারুকলা ইনস্টিটিউট শাহবাগ থেকে বের হয়ে শোভাযাত্রাটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়।

এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। এছাড়া নববর্ষের আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে হালখাতা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পহেলা বৈশাখে হালখাতার মহরত করে নতুনভাবে ব্যবসায়ের যাত্রা শুরু করেন। প্রাচীন নববর্ষের সেই রূপটি আজো আধুনিক নববর্ষ উৎসবের মধ্যে বয়ে চলেছে। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া।

গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। যদিও এলাকার প্রথা অনুযায়ী বাংলাদেশের একেক জায়গায় একেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তবুও পহেলা বৈশাখের এ দিনে সব বাঙালি, হিন্দু, মুসলিমসহ সবাই জাতি ভেদাভেদ ভুলে এ দিনটিকে একসঙ্গে উদযাপন করে। অনেকেই বলেন যে, বাংলা সনের প্রয়োগ নেই। বছরের এই একটি দিনই নিজস্ব সংস্কৃতির ধুয়া তুলে আড়ম্বড়ভাবে পালিত হয়। এরপর সবাই ভুলে যায়- কখন বৈশাখ শেষ হয়, জ্যৈষ্ঠ আসে সে হিসাব রাখার কারও দরকার পড়ে না। অফিস-আদালত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইংরেজি সনের ব্যাপকভিত্তিক প্রয়োগের কারণেই এটা হয়। এই বাস্তবতা যেমন মেনে নিতেই হয়, তেমনি এটাও অস্বীকারের উপায় নেই যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। তাই প্রয়োগ না খুঁজে নতুন বছরের শুরুতে যে বর্ণিল উৎসব, সারা বছরটাকে বর্ণিল করে তোলার জন্য সেটাকে উপভোগ করাই শ্রেয়। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

সর্বশেষ খবর