সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

রমনাতে যেভাবে পান্তা-ইলিশ

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক পান্তা-ইলিশের সমন্বয় হয় ১৯৮৩ সালে। ধীরে ধীরে তা ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। ফলে পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে এখন পান্তা-ইলিশের বিষয়টি সার্বজনীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, বাংলাদেশের এরকম বেশকটি বিষয়ের সূচনা করি। যেমন- ১৯৮৫ সঙ্গে আমরা 'সুন্দর' সংগঠনের মাধ্যমে সুন্দরী প্রতিযোগিতার 'মিস বাংলাদেশ' চালু করতে চেয়েছিলাম। মৌলবাদীদের জন্য তা সম্ভব হয়নি। তবে এখন নানাভাবে নানা নামে 'ফটো সুন্দরী' নির্বাচিত হচ্ছে। থাক সে প্রসঙ্গ। বিডিনিউজ ২৪-এ আর্টসে এপ্রিল ১৪, ২০১১ 'রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনা' শীর্ষক লেখাটির পর অনেকেই এর আসল ইতিহাস জানতে পারেন। তারও আগে দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ মারা যাওয়ার পর 'রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের উদ্যোক্তা বোরহান ভাইকে কেউ কি মনে রাখবে', শীর্ষক একটি লেখা লিখলাম ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ দৈনিক আমাদের সময়ে। সেই সূত্র ধরে বিডিনিউজ ২৪এ আর্টসের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক ব্রাত্য রাইসুর অনুরোধে লেখাটি লিখি। তাতে উপস্থাপন করেছিলাম কীভাবে আমরা এর সূচনা করেছিলাম। ৫ সেগুনবাগিচা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল দৈনিক দেশ এবং সাপ্তাহিক বিপ্লবের কার্যালয়। সে কারণেই সেখানে বসত লেখক আড্ডা। আমি ছিলাম একজন নিয়মিত আড্ডারু। ১৯৮৩ সাল। চৈত্রের শেষ। চারদিকে বৈশাখের আয়োজন চলছে। আমরা আড্ডা দিতে দিতে পান্তা-পিয়াজ-কাঁচামরিচের কথা তুলি। দৈনিক দেশের বোরহান ভাই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দিলেন। আমি সমর্থন দিলাম। প্রথমে আমাকে দায়িত্ব নিতে বললেন। কারণ, সেই আড্ডায় আমিই একমাত্র সেই হাউসে বহিরাগত। ফলে কাজটা সম্পাদন করতে সুবিধা হবে। কিন্তু আমি একা রাজি না হওয়ায়, কবি ফারুক মাহমুদ আমাকে নিয়ে পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। নিজেদের মধ্যে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তোলা হলো। বাজার করা আর রান্না-বান্নার দায়িত্ব দিলেন বিপ্লব পত্রিকার পিয়নকে। সেই হাউসে যারা তখন কাজ করতেন, তাদের মধ্যে বিপ্লবের সম্পাদক কবি সিকদার আমিনুল হক, প্রয়াত বোরহান আহমেদ, কবি ফারুক মাহমুদ, দৈনিক দেশের সাহিত্য সম্পাদক হেলাল হাফিজ, সাংবাদিক মাহবুব হাসান, শহিদুল হক খান, মুন্সী আবদুল মান্নান, রোজী ফেরদৌস প্রমুখ। প্রথমে আমরা পান্তা আর ডিম ভাজা দিতে চাইলাম। কিন্তু ডিমের স্থলে স্থান পেল জাতীয় মাছ ইলিশ। রাতে ভাত রেঁধে পান্তা তৈরি করে, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাজা নিয়ে 'এসো হে বৈশাখে'র আগেই ভোরে আমরা হাজির হলাম বটমূলের রমনা রেস্টুরেন্টের সামনে। সঙ্গে মাটির সানকি। মুহূর্তের মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা ইলিশের। এ নিয়ে অনেকেই তীব্র সমালোচনা করে আমাদের বিরুদ্ধে কলাম লেখেন, আমরা গরিবের 'পান্তা' নিয়ে উপহাস করেছি, সংস্কৃতির নামে ভণ্ডামি করেছি, ইলিশের দাম বাড়িয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে একক কৃতিত্ব নেওয়ার অপচেষ্টা করেছেন। বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সার্বজনীন উৎসব! যা ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠী সেই ষাট দশক থেকে অদ্যাবধি নানান প্রতিকূলতার মধ্যে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালি জাতিকে দিয়েছে এক অফুরন্ত সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ষাট দশকের প্রতিপক্ষরা নতুনভাবে আবিভর্ূত হয়ে ভিন্নভাবে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মেরে নসাৎ করতে চেয়েছে উৎসবকে। কিন্তু পারেনি। পারবেও না কোনোদিন! বরং বৃদ্ধি পাবে, মাত্রা পাবে, যুক্ত হবে নতুন কিছু। যেমন যুক্ত হয়েছে চারুকলার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা কিংবা আমাদের চালু করা পান্তা-ইলিশের সংযোজন!

সর্বশেষ খবর