সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

রেলে সাত বছরে সহস্রাধিক দুর্ঘটনা, হতাহত ১২৩৫

গত সাত বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন সহস্রাধিক রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। আর এসব দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন মোট এক হাজার ২৩৫ জন। এর মধ্যে নিহত হয়েছেন ২৪১ জন। এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ যান্ত্রিক ত্রুটি, স্টেশন পর্যায়ে কর্মরত স্টেশন মাস্টারসহ কর্মকর্তাদের অসতর্কতা, সিগন্যাল অমান্য করা, চালকদের অসতর্কতা, ইঞ্জিনের ত্রুটি এবং লেভেল ক্রসিং অমান্য করে বাস, ট্রাক ও প্রাইভেট গাড়ি রেল লাইনের ওপরে উঠে যাওয়া। শনিবার দিবাগত রাতে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া রেল স্টেশনে দুটি ট্রেনের যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে এর মূল কারণ চালকের অসতর্কতা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ট্রেনের চালক এবং সহকারী চালক দুজনই অসতর্ক কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা হয়। অধিকাংশ ঘটনায়ই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। তারপরও দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রেলের এই দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুখোমুখি ট্রেন দুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশে কমই ঘটে। বছরে এক বা দুটি ঘটনা ঘটে। তবে এই দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্যই রেলের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ সব ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া হয়। তিনি জানান, ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা রোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রেলওয়েতে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলকভাবে কম। তবে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে সেগুলোর ভয়াবহতা মারাত্মক। কারণ এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে চালকদের সিগন্যাল অমান্য করাই হচ্ছে অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, চালকরা একটু অসতর্ক হলে কিংবা ঘুমিয়ে পড়লে সিগন্যাল অমান্যের ঘটনা ঘটে। শনিবার গভীর রাতে উল্লাপাড়ায় লালমনিরহাট এঙ্প্রেস ও একতা এক্সপ্রেসের মধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটিও ঘটেছে চালকদের অসতর্কতার কারণে। এর বাইরে কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার, সিগন্যাল ম্যানের অবহেলা ও অসতর্কতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। রেলওয়ের পাকশী বিভাগের ব্যবস্থাপক পঙ্কজ কুমার সাহা জানিয়েছেন, সিগন্যাল অমান্য করার কারণে এই 'একতা এক্সপ্রেসের সঙ্গেই গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ায় 'সীমান্ত এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রেলওয়ের দাফতরিক তথ্য অনুযায়ী গত সাত বছরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। এর মধ্যে ২০০৫-০৬ সালে ঘটে তিনটি। ২০০৬-০৭ সালে একটি, ২০০৭-০৮ সালে তিনটি, ২০০৮-০৯ সালে সাতটি, ২০০৯-১০ সালে দুটি, ২০১১-১২ সালে একটি। এর বাইরে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মূলত রেল লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষ, চালক কিংবা স্টেশন মাস্টার যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী লেভেল ক্রসিং অমান্য করে রেল লাইনের ওপরে উঠে যাওয়া যানবাহন। তবে অনেক সময় লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্বপালনকারী গেট কিপার না থাকার কারণে কিংবা গেট কিপারের অসতর্কতার কারণে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

এদিকে রেলে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সাত বছরের খতিয়ান থেকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত কিংবা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রেলওয়ের প্রচলিত ব্রিটিশ আমলের নিয়মেই শাস্তি হয়। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেওয়া হয় দোষীদের। এর মধ্যে বিভাগীয় মামলা, ফৌজদারি মামলা, চাকরি থেকে অব্যাহতি, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করে দেওয়াসহ বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটলে দোষীদের বিচারিক আদালতের মুখোমুখি হতে হয় এবং শাস্তি ভোগ করতে হয়।

উল্লাপাড়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি : শনিবার গভীর রাতে উল্লাপাড়া রেল স্টেশনে লালমনিরহাটগামী লালমনিরহাট এঙ্প্রেস ও বিপরীত দিক থেকে আসা ঢাকাগামী একতা এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে একতা এক্সপ্রেসের চালক বঙ্কিম চন্দ্র রায় এবং তার সহকারী আবদুস শাফী, একতা এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) এবং উল্লাপড়া স্টেশনের মাস্টার খান মনিরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

গতকালের দুর্ঘটনার জন্য সম্ভাব্য দুটি কারণকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি, একতা এঙ্প্রেসের চালক, সহকারী চালক ও গার্ড অসতর্ক ছিলেন বা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে স্টেশন মাস্টার সময়মতো সিগন্যাল বাতি জ্বালাননি।

তিনি জানান, এ ঘটনায় পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার তিনটিই হচ্ছে রেলওয়ে থেকে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্টকে। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার ও চিফ মেডিকেল অফিসার। বিভাগীয় পর্যায়ে গঠিত অন্য কমিটির প্রধান করা হয়েছে পাকশী ডিভিশনাল ট্রান্সপোর্টেশন অফিসারকে। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন ডিভিশনাল মেকানিক্যাল অফিসার (লোকো), ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার-২, ডিভিশনাল সিগন্যাল

অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার ও ডিভিশনাল মেডিকেল অফিসার। এই তিন কমিটিকেই আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কে এম আলী আজমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক।

 

সর্বশেষ খবর