সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

ছায়ানটের \\\'আলোকবর্তিকা\\\' সনজীদা খাতুন

ছায়ানটের \\\'আলোকবর্তিকা\\\' সনজীদা খাতুন

বাঙালির প্রাণের উৎসব আজ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে বাংলা নববর্ষে গোটা জাতি একত্রিত হয়ে আজ আনন্দ উদযাপন করবে। তবে এ আনন্দ-উৎসবের শুরুর কথা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৬১ সালে। সে সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ পূর্তির উৎসব পালন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, থমথমে পরিবেশে বেশ কিছু বাঙালি একত্রিত হয়েছিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তখন কবিগুরুকে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে কিছু রবীন্দ্র অনুরাগী নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেননি। আর সেবার রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর আয়োজন বাংলার এ প্রান্তের সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন হচ্ছেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সনজীদা খাতুন। বিশিষ্ট এ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মীকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা গভীর শ্রদ্ধা করেন। একইভাবে ছায়ানটের প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীর মাথার ওপর সনজীদা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন 'আলোকবর্তিকা' হয়ে। মূলত ১৯৬১ সাল থেকেই সনজীদা খাতুনসহ অন্যরা 'শ্রোতার আসর' নামে ঘরোয়া আসর বসাতেন। তখন তারা অনুভব করেন, দেশে সে সময় সে অর্থে রবীন্দ্র শিল্পীর অভাব রয়েছে। প্রয়োজন হলো একটি সংগীত বিদ্যালয়ের। জানা যায়, সনজীদা খাতুনের সঙ্গে সে সময় রবিঠাকুরের শতবর্ষ উদযাপনের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন বিচারপতি মাহাবুব মুর্শেদ, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বুদ্ধিজীবী। এর সঙ্গে সংস্কৃতি কর্মীরাও যুক্ত হয়েছিলেন। শতবর্ষের অনুষ্ঠান উদযাপন শেষে এক বনভোজনে গিয়ে কবি সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান, সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান, আহমেদুর রহমান, ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, মীজানুর রহমান, সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিক ও সনজীদা খাতুনসহ আরও অনেক অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৩ সালে ছায়ানটের যাত্রা শুরু হলো। এর পর রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, শুদ্ধসংগীত, পল্লীগীতিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হলো। সনজীদা খাতুনরা তখন মানুষের ঐতিহ্যপ্রীতি বাড়াতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করার রীতি শুরু করেন। তবে শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৯৭১ সাল ছাড়া প্রতিবছরই রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উদযাপন করে আসছে ছায়ানট।

ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষে বাংলা নববর্ষের আহবান। ছায়ানটের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঢাকার রমনা উদ্যানে অশ্বত্থ গাছের নিচে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাত, ইংরেজি ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় বটমূল। স্বাধীনতার পর ছায়ানটের কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য নিয়েছিলেন। জানা যায়, সে সময় প্রথমবার সরকারের তরফ থেকে ৪০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। এর পর ৩৫ হাজার। তারপর ২৫ হাজার। এ সংখ্যা ক্রমেই কমতে কমতে ১০ হাজার টাকায় এসে ঠেকল। সে সময় কবি সুফিয়া কামালকে সনজীদা খাতুন সরকারের কাছ থেকে এরকম অসহযোগিতার কারণে অর্থ সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারে নিজের অনাগ্রহের কথা জানান এবং এ বিষয়ে করণীয় কী তা জানতে চাইলে প্রতিউত্তরে সুফিয়া কামাল সনজীদাকে বলেন, 'ওদেরকে লিখে দাও যে, এ অর্থ গ্রহণে আমরা অপারগ।' আর এ কথাটি লিখে দেওয়ার মাধ্যমেই সরকারের কাছ থেকে ছায়ানটের আর্থিক সাহায্য নেওয়ার সমাপ্তি ঘটে। এর পেছনে অবশ্য ছায়ানটের সদস্যদের ধারণা এই যে, সরকারের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিলে তা যে কোনো সরকারই ক্ষমতায় আসুক তাদের সঙ্গে ছায়ানটকে অাঁতাত করে চলতে হবে। আর ছায়ানট এতে রাজি হয়নি। কারণ সনজীদা ও তার সহকর্মীরা নিজেদের একটি স্বাধীন সত্তা রাখতে চেয়েছিলেন। তবে এখন দৃশ্য পাল্টেছে। কালক্রমে ছায়ানটের ছাত্র-ছাত্রী সূত্রে প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস তৈরি হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ সংগীতজ্ঞ মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রসংগীত শিখছেন ও শুনছেন। এখনো শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে তিনি আনন্দ পান। গান সনজীদা খাতুনের নেশা। তবে রবীন্দ্রসংগীতে আগ্রহ থাকলেও সনজীদা নজরুলগীতি, আধুনিকগীতি ও পল্লীগীতি সব সংগীতই শিখেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক তার গানের শিক্ষিকা সনজীদা খাতুন প্রসঙ্গে বলেন, 'সনজীদা খাতুন আমাদের মাথার ওপর আলোকবর্তিকা। তিনি শুরু থেকেই সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।' সনজীদা খাতুন ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

পরে ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাকে 'রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য' উপাধি দেয়। তাকে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ সম্মাননা 'দেশিকোত্তম' দেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

 

সর্বশেষ খবর