শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

বিএনপিতে উল্লাস, আওয়ামী লীগে অপেক্ষা

বিএনপিতে উল্লাস, আওয়ামী লীগে অপেক্ষা

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আশা করছে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরাল হবে। এ জন্য তারা নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় থাকবে। দলটি মনে করে অসম্পন্ন চুক্তিগুলো বিশেষ করে তিস্তার পানিসহ সীমান্ত সমস্যার সমাধান হবে খুব শীঘ্রই। তবে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন অনেকটাই উল্লসিত। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলে ভারতের কংগ্রেস সরকারের এতদিনের একপেশে নীতির অবসান ঘটবে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে। উভয় দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ মনে করে, শুধু কংগ্রেসই নয় বিজেপির সঙ্গেও বরাবর আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ও আর্থিক চুক্তি সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া গঙ্গা চুক্তি, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধাসহ দ্বিপক্ষীয় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বিজেপি সরকারের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছিল। ভবিষ্যতেও নতুন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।

অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলেন, এর আগে যে একপেশে নীতি ছিল, বিশেষ করে কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের একটি অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, নতুন সরকার তা পুনর্মূল্যায়ন করবে। নতুন সরকার একপেশে নীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। সম্পর্ক হবে দুই দেশ ও জনগণের সঙ্গে। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দিলি্ল সফর করে ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকেও এ বিষয়টি বলে এসেছেন। ওই সময় তারাও এতে একমত পোষণ করেন।

আওয়ামী লীগ : দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দেশের সঙ্গে দেশের। সরকারের সঙ্গে সরকারের। ভারতের সঙ্গে আমাদের সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আগামীতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখনো বিজেপি ক্ষমতায় ছিল। অটল বিহারি বাজপেয়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় আমি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম। তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাজারব্যবস্থা চালু করেছিলাম। ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে আমাদের সরকারের সম্পর্ক আরও বেশি মজবুত ও শক্তিশালী হবে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বে কোনো ফাটল ধরবে না। বিদায়ী ভারত সরকার বাংলাদেশকে যেসব আশ্বাস দিয়েছে এ সরকারও তা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করবে এতে সন্দেহ নেই। কংগ্রেসের মতো বিজেপির সঙ্গেও আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক রয়েছে।

দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ভারতের নির্বাচন নিয়ে আমাদের উল্লসিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দুই দেশের বিরাজমান সম্পর্ক আগামীতে আরও ইতিবাচক ধারায় অব্যাহত থাকবে।

প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর মতে, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয়। কোনো দলের বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়। সবসময়ই ভারতের সব সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম সরকার গঠন করে তখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল না। কিন্তু তখন ভারতের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি করা হয়েছিল। একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। সরকার গঠন করতে গিয়ে যে পরিমাণ আসন পাওয়া দরকার তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন। কাজেই কোনো চুক্তির বিষয়ে কারও সমর্থন চাইতে হবে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয় এখনো অমীমাংসিত আছে সেগুলো খুব শীঘ্রই এখন সমাধান হবে। নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি নিয়ে অনেক সময় কথাবার্তা থাকলেও ভারতের বৈদেশিক নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। তাদের নীতি সবসময়ই এক থাকে। কাজেই সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই ভালো। কাজেই নতুন একটা সরকার এলেই যে তা নষ্ট হয়ে যাবে তা নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ভারতের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক ওই দেশের সব রাজনৈতিক দলই এক এবং অভিন্নভাবে দেখে। জনগণ যাকে ভোট দিয়েছে সে-ই ক্ষমতায় বসবে। সবসময়ই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো ছিল। ভবিষ্যতে ভারত বা বাংলাদেশ কেউ কারও বিপক্ষে যাবে না। দুই দেশের সরকার ঐক্যবদ্ধ হয়েই কাজ করবে। যেখানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান হবে না। বিজেপি সরকার আগেও ছিল। কাজেই আগামীতে সম্পর্ক আরও বেশি ভালো হবে। বিগত পাঁচ বছরে অনেক অর্জন রয়েছে। বেশকিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো এগিয়ে যাবে।

বিএনপি : দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়ে আমরা অভিনন্দন জানাই। আশা করি, এ বিজয়ের মাধ্যমে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে ভারতের নতুন সরকার উদ্যোগ নেবে। বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে আমরা 'গণতন্ত্রেরই বিজয়' বলে মনে করি।

তিনি বলেন, আমরা আশা করি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে নতুন সরকার কাজ করবে। নতুন সরকার বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে। তিস্তার পানি সমস্যাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ বিভিন্ন অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে তারা এগিয়ে আসবে। ভারতের নতুন সরকার সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলে আমরাও সহযোগিতা করব।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, ভারতের নতুন সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানাই। ভারতের জনগণ যা সঠিক মনে করেছে তারা তা-ই করেছে। তাদের এ রায়কে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করি দুই দেশের মধ্যে যে বিরাজমান সমস্যাগুলো রয়েছে তা বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে সমমর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে সমাধান হবে। ভারতের মতো বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কংগ্রেসের মতো আওয়ামী লীগেরও পতন হতো। তবে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পতন হবে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের ভাষায়- বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ সম্পর্ক সৃষ্টির উদ্যোগ অতীতে নেওয়া হয়েছে দুটি দেশের মধ্যে নয়, দুটি দেশের জনগণের মধ্যে নয়, বরং দুটি দেশের দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অর্থাৎ যখন দুই দেশের যে কোনো একটির সরকার ভেঙে পড়ে তখন দুই দেশের মধ্যেও সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। আসলে ওই সম্পর্ক স্থায়ী ও দৃঢ় করতে হলে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে। তা হলো দুই দেশের মানুষের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি সৃষ্টি। যদি সাউথ ব্লক নির্ধারণ করে যে ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে বোঝাপড়া করবে তাহলে এটা তো অবশ্যম্ভাবী যে দিলি্লতে কংগ্রেসের হৃদকম্পন সৃষ্টি হবে। অতীতে এমন সময় গেছে যখন দিলি্লতে বিজেপি ও বাংলাদেশের বিএনপি সরকার সমান্তরালভাবে কাজ করেছে। ভবিষ্যৎ বলে দেবে আগামীতে দিলি্ল সরকার পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।

ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা কাজ করতে প্রস্তুত আছি। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে। অতীতে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করেছে বলে এ দেশের জনগণ মনে করে। আমরা আশা করি, নতুন সরকার বাংলাদেশের সব দল সর্বোপরি দেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করবে। দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিরসনে ভারত সরকার ইতিবাচকভাবে এগিয়ে এলে বিএনপিও সার্বিক সহযোগিতা করবে বলে জানান সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে যে একপেশে নীতি ছিল, বিশেষ করে কংগ্রেস সরকার একটি অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, নতুন সরকার তা পুনর্মূল্যায়ন করবে। তারা একপেশে নীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। সম্পর্ক হবে দেশ ও দেশের জনগণের সঙ্গে। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দিলি্ল সফর করে ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকেও এ বিষয়টি বলে এসেছেন। তারাও এতে সম্মতি দিয়েছেন। আমার মনে হয়, বাংলাদেশেও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কংগ্রেসের চেয়েও শোচনীয় পরাজয় ঘটবে আওয়ামী লীগের।

 

সর্বশেষ খবর