শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

কংগ্রেসের করুণ পরাজয়ের যত কারণ

পশ্চিমবঙ্গে ঘাসফুল ভারতজুড়ে পদ্মফুল ফল মেনে নিয়ে অভিনন্দন সোনিয়ার

কংগ্রেসের করুণ পরাজয়ের যত কারণ

টানা ১০ বছরের কংগ্রেস শাসনামলের অবসানই ঘটেনি, ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ৬০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ পরাজয় দেখেছে দলটি ও গান্ধী পরিবার। গান্ধী পরিবারের দুই পুত্রবধূ ও দুই সন্তান দুই শিবির থেকে জিতলেও কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণ খুঁজছেন নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আর পর্যবেক্ষকদের হিসাবের খাতা খুলে গেছে। যারা পরিবর্তনের হাওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন তারও বুঝতে পারেননি কংগ্রেস সেনাপতি রাহুল গান্ধীর কপালে এমন পরাজয় ঘটবে। নরেন্দ্র মোদি ঝড় বা সুনামিতে পশ্চিমবাংলায় ঘাসফুল ফুটলেও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বুকজুড়ে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া বিজেপির পদ্মফুল ফুটে গেছে।

কংগ্রেসের পাঞ্জা অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়ায় কার্যত ভোটের ময়দানে লড়াই হয়নি। যেন নরেন্দ্র মোদি এলেন, দেখলেন আর দিলি্ল জয় করলেন। গুজরাট দাঙ্গার কারণে পশ্চিমা দুনিয়া নরেন্দ্র মোদিকে বাঁকা চোখেই দেখেছিল। প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা পর্যন্ত দেয়নি। কিন্তু কংগ্রেসের ব্যর্থতার পাল্লা এতটাই ভারী হয়ে উঠেছিল যে বিজেপি নয়, নরেন্দ্র মোদিকেই দিলি্লর মসনদের চেয়ার তুলে দিতে হলো।

হিন্দুত্ববাদের অহঙ্কার থেকে নরেন্দ্র মোদি সরে দাঁড়াননি। আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের আঁতুড় ঘর থেকেও নড়েননি। কিন্তু এক বছর আগে থেকেই তিনি কোমর বেঁধে নেমেছিলেন ভোটের লড়াইয়ে।

গুজরাটের উন্নয়ন মডেল সামনে নিয়ে ভারতবাসীকে বলেছিলেন, 'আমাকে শক্তিশালী সরকার দিন, আমি আপনাদের শক্তিশালী ভারত দেব।' 'মা-বেটার শাসন' বলে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও ভোটযুদ্ধের সেনাপতি রাহুল গান্ধীকে মাঠে-ময়দানে তুলাধোনা করেছেন। জ্ঞানী, পণ্ডিত, বিচক্ষণ, সৎ, মেধাবী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে গান্ধী পরিবারের হাতের পুতুল বানিয়ে ছেড়েছেন মানুষের কাছে। বিজেপির প্রবীণ নেতা এল কে আদভানি, সুষমা স্বরাজ, মুরলি মনোহর জোশিদের কোণঠাসা করে দলের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীই ঘোষণা করেননি, সর্বত্র জুতসই প্রার্থী দিয়ে একটি পরিকল্পিত, সংগঠিত ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন আটঘাট বেঁধেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্যাম্পেইন ছক যারা করেছিলেন তাদেরই নিজের প্রচারের জন্য এনেছিলেন তিনি।

দিলি্লই নয়, ভারতজুড়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও পথে পথে বসিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও তার প্রতীকসহ স্লোগান। 'বহুৎ হোয়া ভ্রষ্টাচার, আপকোবার মোদি সরকার' এমন নানা স্লোগানে তিনি মানুষকে স্পর্শ করেছিলেন। বেলা শেষে অপরিকল্পিতভাবে উদ্দেশ্যহীন নাবিকের মতো দুর্বল তরীর মাঝি হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। গান্ধী পরিবারের তালুক খ্যাত আমেথিতে ২০০৪ সাল থেকে বিজয়ী হয়ে এলেও ভারতবর্ষ ঘুরেছেন, কৃষকদের সঙ্গে মাঠে বসে গেছেন কিন্তু সংসদের ভিতরে-বাইরে তার একটি বক্তৃতাও গণতান্ত্রিক ভারতের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি।

প্রচার-প্রচারণা থেকে ভোট লড়াইয়ের নমুনা ছিল দায়সারা গোছের। যেন ভোটের আগেই হেরে বসেছিলেন রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস। দাদি ইন্দিরার অবয়ব নিয়ে প্রিয়াঙ্কা আমেথির মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে রাহুলকে জেতালেও কংগ্রেসকে টানা বা দেখার সুযোগ ও সময় ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান তুলেছেন, সব মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলেছেন, ১০ বছরের শাসনামলে কংগ্রেস কী দিয়েছে তার সুনির্দিষ্ট চিত্র যেমন মানুষের সামনে হাজির করতে পারেননি, তেমনি নরেন্দ্র মোদি ঝড় সামলানো দূরের কথা, বাকিদের সমালোচনার জবাব দিতেও পারেননি। নেতৃত্বহীন কংগ্রেসের সেনাপতি এতটাই দুর্বলতা দেখিয়েছেন যে মোদির বিপরীতে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী তাও পরিষ্কার করতে পারেননি। বাজপেয়ির শাসনামলের উন্নয়নের মুখে ২০০৪ সালে সোনিয়া গান্ধীর ক্যারিশমায় কংগ্রেস জোট ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীলদের নিয়ে ভোটের লড়াই করে ক্ষমতায় এসেছিল। টানা দুইবার জিতলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে ?উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু ২০১১ সালে কংগ্রেসের জন্য তুমুল বিতর্কের আর সমালোচনার ঝড় নেমে এসেছিল। কয়লা-বিদ্যুতে, কমনওয়েলথ গেমসে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সমালোচনার ঝড় খেলে গেছে ভারতজুড়ে। শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গরিব-মেহনতি মানুষের বুকের আগুন জ্বলেছে, প্রতিবাদের হাত উঠেছে দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে। সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত হওয়া ছাড়া কিংবা জনগণের আস্থা থেকে কংগ্রেস ছিটকে পড়া ছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

রুপির বিপরীতে ডলারের দাপট বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। নানান সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজকোষ খালি হয়েছে। কংগ্রেসের একটা অংশ লুটেপুটে খেলেও মানুষের দুয়ারে তা পৌঁছেনি। দলের কর্মীদের সঙ্গেও কংগ্রেস নেতৃত্বের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে সাংগঠনিক দুর্বলতা চরম আকার নিয়েছে। আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ভারতবাসীকে প্রতিবাদীই করেনি, কংগ্রেস সরকারকে বড় ধরনের আঘাত দিয়েছে। আম আদমি পার্টির জন্ম ও কেজরিওয়ালের আবির্ভাব কংগ্রেসের সমালোচনার ভিতর দিয়েই গড়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে দাঙ্গা হবে- এই বলেই পথ হেঁটেছেন রাহুল গান্ধী। ২০০৪ সালের পর থেকে জোট ছেড়ে চলে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে না কাছে টেনেছেন, না দলকে সুসংগঠিত করেছেন। মোদি যেখানে তার শক্তি সুসংগঠিত করে তার ওপর দাঁড়িয়ে লড়ছিলেন, রাহুল সেখানে ছিলেন অতিশয় দুর্বল সেনাপতি। না ছিল অস্ত্র, না ছিল সৈন্য।

বাগ্মিতায় ক্যারিশমায় নরেন্দ্র মোদি দিনে দিনে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেস জমানার অবসান ঘটিয়ে পরিবর্তনের হাওয়া তুলতে সাধারণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা বক্তৃতায় জনতার ঢল নামিয়েছেন। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন কংগ্রেসবিরোধী শক্তির মহীরুহ। বিপরীতে রাহুল গান্ধী ছিলেন নিষ্প্রভ, বর্ণহীন, ধূসর এক দুর্বল সেনাপতি। কংগ্রেসের প্রচারের দায়িত্বে থাকা রমেশকে প্রিয়াঙ্কা যখন জবাবদিহিতার মুখোমুখি করেছিলেন তখন ভোটের লড়াই মোদির অনুকূলে চলে যায়। আঞ্চলিক দুর্গ গড়ে যারা নরেন্দ্র মোদি ও তার রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন বিভক্ত। অর্থাৎ প্রগতিশীল শক্তির বিভক্তির মুখেই গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি গেরুয়া পোশাক পরে অ্যারিয়ান হর্সের মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গেই তিনি গেছেন সাতবার। ভোটের আনুপাতিকহারে কংগ্রেসের ওপরই তার অবস্থান। মোদি ঝড়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের রাজনৈতিক দুর্গ। শুধু গুজরাট নয়, রাজস্থানসহ সব কটি এলাকার আসন ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি।

ভোটের ময়দানে নরেন্দ্র মোদি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন। পরিবারতন্ত্র হটিয়ে মেহনতি মানুষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। গুজরাট দাঙ্গার বিতর্ক ছাড়া নিজেকে একজন যোগ্য ও দক্ষ কৌশলী, সৎ প্রশাসকের মডেল হিসেবে ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তিনি বিজেপিকে পেছনে ফেলে নিজেকে সামনে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের অনুভূতিতে হাত দিয়েছেন। বলেছেন, 'আমরা যারা মেহনত করি সেই সাধারণ মানুষ কেন ক্ষমতায় আসতে পারব না। কেন বারবার গান্ধী পরিবার ভারত শাসন করবে।' তিনি আকুতি জানিয়েছেন 'কংগ্রেসকে ষাট বছর দেখেছেন আমাকে ৬০ মাস দেখুন। আমি ভারতকে এক নম্বরে নিয়ে যাব।' দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊধর্্বগতি আর চারদিকের ছুড়ে দেওয়া সমালোচনার বিষাক্ত তীরের ভারে কংগ্রেসের তরী ডুবতে দেখেছেন রাহুল গান্ধী। আর প্রকাশ্য ও গোপন ব্যালট বিপ্লবে ভারত জয় করেছেন নরেন্দ্র মোদি। জবাব দেওয়া দূরের কথা রাহুল বা কংগ্রেস মূলত দাঁড়াতেই পারেননি মোদি ঝড়ের সামনে। অসুস্থ সোনিয়া গান্ধীর অনুরোধে নেতা-কর্মীরা রাহুল ও মনমোহনকে ছেড়ে দিলেও হতাশা-বিষণ্নতা তাদের মুখজুড়ে। এ ছাড়াও কংগ্রেসের নিয়তিতেই বাঁধা ১০ বছর পর পর অভিশপ্ত হতে হয় ভোটযুদ্ধে। ১০ বছর পর এবারও তা-ই হয়েছে। তবে এবার মাসুলটা হয়েছে চড়া।

 

সর্বশেষ খবর