শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

মেঘনায় ৩২ লাশ উদ্ধার দেড়শ নিখোঁজ

মেঘনায় ৩২ লাশ উদ্ধার দেড়শ নিখোঁজ

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে এ পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে যতই সময় গড়াচ্ছে বেড়ে চলেছে লাশের সংখ্যা। এখনো প্রায় দেড় শ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন। কিন্তু নিখোঁজদের কেউ আর জীবিত নেই বলেই আশঙ্কা করছেন স্বজনরা। শুধু প্রিয়জনের লাশটি পাওয়ার জন্যই হাজারো মানুষ তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন মেঘনাপাড়ে। উদ্ধারকারী দলের পাশাপাশি অনেকেই দেশীয় নৌকা ও ট্রলার নিয়ে মেঘনার বুক চষে বেড়াচ্ছেন, খুঁজে ফিরছেন লাশ। মেঘনার দুই পাড়ের বাতাস স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে। মাতম চলছে শরীয়তপুরেও। লঞ্চডুবির ঘটনায় হতাহত ও নিখোঁজ যাত্রীদের বেশির ভাগই শরীয়তপুরের নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার অধিবাসী।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় মেঘনায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, লঞ্চের ভিতরে এখনো অনেক লাশ রয়েছে। গতকাল রাতের মধ্যেই লঞ্চটি তীরে এনে সব লাশ উদ্ধার সম্ভব হবে। সকালেই ডুবন্ত লঞ্চের দুই মাথায় ক্রেনের সাহায্যে রশি বেঁধে দেওয়া সম্ভব হয়। পরে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক পাশের রশি ছিঁড়ে লঞ্চটি আবার সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। এর ফলে লঞ্চ উদ্ধার চেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় লঞ্চের গায়ে ক্রেনের সাহায্যে রশি বাঁধতে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা। দ্বিতীয়বার টেনে তোলার চেষ্টাকালে আবারও ক্রেনের রশি ছিঁড়ে গেলে অপেক্ষমাণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বেলা ১১টার দিকে লাশ ও লঞ্চ উদ্ধার তৎপরতায় গড়িমসির অভিযোগ তুলে নদীপাড়ে অপেক্ষমাণ স্বজনরা উদ্ধার তৎপরতা জোরদারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তবে বিকাল ৫টার দিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির কিছু অংশ পানির ওপর জাগিয়ে তুলতে দেখা গেছে। বিআইডব্লিউটিএ-এর উদ্ধারকারী নৌযান 'প্রত্যয়'-এর ক্রেনের মাথায় আটকে রাখা হয়েছে মানুষখেকো লঞ্চটিকে।

'ক্রেনের রশি ছিঁড়ে যাওয়ায় লঞ্চ উদ্ধার কাজে সময় ক্ষেপণ হয়েছে' স্বীকার করে বিআইডবি্লউটিএ-এর চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা বলেন, চেষ্টার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (ত্রাণ) বলেন, 'আশা করছি শুক্রবারের (গতকাল) মধ্যেই লঞ্চ উদ্ধার হবে। দুর্ঘটনার শিকার কিছু মানুষ সাঁতরে পাড়ে উঠতে পেরেছেন। আমাদের কাছে পাওয়া তথ্যানুযায়ী লঞ্চে প্রায় তিন শ যাত্রী ছিলেন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।' তিনি জানান, 'এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লাশ হস্তান্তরের সময় নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।' বৃহস্পতিবার রাত থেকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছেন।

উল্লেখ্য, দুর্বার ও প্রত্যয় নামে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। বিআইডবি্লউটিএ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৫ জন ডুবুরি উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয়রাও উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছেন। ৩০ থেকে ৪০টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীতে তল্লাশি চালাচ্ছে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন।

নিমজ্জিত লঞ্চটি এক পাশে কাত হয়ে পলি ও বালু দ্বারা ভরাট হয়ে যাওয়ায় এমভি মিরাজ-৪-কে উদ্ধার করতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি রিলিং সিডি মোস্তাফিজ। ডুবুরিরা আরও জানান, লঞ্চটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ত্রিপল দ্বারা চারপাশ ভালোভাবে আটকে দেওয়া ছিল। সেই ত্রিপল, লঞ্চের মালামাল ও লাশ ফুলে-ফেঁপে জানালা-দরজাগুলোয় দেয়ালের মতো আবরণ গড়ে উঠেছে। এ কারণে ডুবুরিরা স্বচ্ছন্দে লঞ্চের ভিতরে প্রবেশ করতে পারছেন না, ফলে উদ্ধার কাজে বেশি সময় লাগছে বলেও দাবি করেন কর্মকর্তারা। ঠিক কখন দুর্ঘটনাকবলিত এমভি মিরাজ-৪ উদ্ধার করা সম্ভব হবে তা উদ্ধারকারীরা জানাতে পারছেন না।

২৮ জনের নাম-পরিচয় : এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ৩২টি লাশের মধ্যে ২৮ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর গ্রামের শ্রীদম দাশের ছেলে কৃষ্ণ কমল দাশ (৫০), কমল দাশের মা লক্ষী দাশ (৮৫), একই উপজেলার পটিয়া গ্রামের ইউনুস মোল্লার ছেলে মিন্টু মোল্লা (৪০), খলিল সৈয়ালের মেয়ে রহিমা (৩২), সখিপুর উপজেলার দুলারচর গ্রামের সাজু দেওয়ানের স্ত্রী লাইলি বেগম (৫০), নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বরের আরব আলী মালতের ছেলে আবদুল জলিল মালত (৫০), একই উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামের ফজলুল হক আকন্দের স্ত্রী সেতারা বেগম (৫৫), পাঁচগাঁও গ্রামের লিটন কাজীর স্ত্রী টুম্পা বেগম (২৬), মেয়ে সুমনা (৮), নূরুল ইসলামের ছেলে আবদুল জলিল (৫৫), কলকাঠি গ্রামের আবদুল মান্নান দেওয়ান (৫০), নড়িয়ার এলাহী বঙ্রে ছেলে জামাল শিকদার (৫০), পণ্ডিতসার গ্রামের মিজানুর রহমানের মেয়ে মাহি (৪), আব্বাস হোসেনের ছেলে মানিক (১৪), সুরেশ্বর দরবারের জালাল শিকদারের ছেলে আবির (২), চাকধ গ্রামের মাসুম মিয়ার ছেলে আবদুল্লাহ আল রেদোয়ান (৪০), দিনারা গ্রামের ইদ্রিস শেখের স্ত্রী রাশিদা বেগম (৬০), নন্দনসার গ্রামের হোসেন আলীর ছেলে খোরশেদ আলী (৭৫), মঙ্গলসার গ্রামের জলিল মোল্লার ছেলে ওসমান গনি মোল্লা (৪০), কুলকাঠি গ্রামের রহিম ফকিরের ছেলে ইসমাইল ফকির (৬৫), নড়িয়ার শাহিনুরের স্ত্রী রিয়া বেগম (২৫), পাইকপাড়া গ্রামের দুলাল বেপারীর স্ত্রী রহিমা বেগম (৫৫), উপালি গ্রামের রিপন মৃধার মেয়ে রিতু আক্তার (১২), পূর্ব নড়িয়ার হাফিজ বেপারীর স্ত্রী ডরমা আক্তার (৩২), আবদুল খালেকের ছেলে মাসুম (৪০), পূর্ব চরকৃষ্ণ গ্রামের লতিফ শিকদারের ছেলে আবদুল কাদের শিকদার। অন্য লাশগুলোর পরিচয় শনাক্তের কাজ চলছে।

বিচ্ছিন্ন চরেই অপেক্ষার পালা : গজারিয়ার দৌলতপুর এলাকা। গ্রামের শেষ প্রান্ত হয়ে বয়ে গেছে মেঘনা। নদীর তীর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো জনবসতি নেই। নেই কোনো গাছপালা। কড়া রোদেও অপেক্ষার ক্লান্তি নেই তাদের। চোখের জল আর মাথার ঘাম যেন এক হয়ে গেছে। প্রায় বিচ্ছিন্ন চরেও হাজারো উৎসুক মানুষের অপেক্ষা। স্বজন হারানো মানুষের চোখের জলে অপেক্ষা। উদ্ধারকর্মীদের অপেক্ষা লাশ আর লঞ্চ উদ্ধারের। সেই সঙ্গে অপেক্ষমাণ মেঘনাপারবাসী।

প্রতিটি লাশের জন্য ৭০ হাজার টাকা : এদিকে দুর্ঘটনাস্থলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিআইডবি্লউটিসির কল্যাণ তহবিল থেকে প্রত্যেক লাশের জন্য ৫০ হাজার এবং স্থানীয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার- এই ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।

বর্ষার দুই মাস ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত : নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে আগামীতে বর্ষার দুই মাস ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেবে বিআইডবি্লউটিএ। তিনি বলেন, বর্ষায় হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়লে ছোট ছোট লঞ্চ সামলে উঠতে পারে না। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিআইডবি্লউটিএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না : বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না, বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না বলে ১১ বছরের ছেলেকে হারিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন আর বুক চাপড়াচ্ছেন বাবা মোহাম্মাদ আলী (৪০)। দুর্ঘটনার সময় সাঁতরে ছেলে আরিফকে ফেলে নিজে প্রাণে বেঁচে আসা ভেদরগঞ্জের মোহাম্মাদ আলী বারবার বুক চাপড়ে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তার কান্নায় মেঘনাপাড়ের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তিনি জানান, "লঞ্চটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার তিন-চার মিনিট আগে তার বুকের ধন আরিফ তাকে জাপটে ধরে বলেছিল, 'বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না'। কিন্তু আমি তারে ফেইল্যা আইছি। আমি পারি নাই তারে বাঁচাইয়া আনতে। মরণব্যাধি ক্যানসার তারে নিতে পারে নাই। আমার জমি বেইচা ৮ লাখ টাকা খরচ করে দুই বছর হয় তারে ভালো করেছি। কিন্তু আজ আমার কী হইয়া গেল নিজেই আমার বুকের মানিককে ফেইল্যা আইছি।' তার এ আর্তনাদ আর আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না কেউ।

সাতজনের পরিবারের ছয়জনই নিখোঁজ : একই পরিবারের সাতজনের মধ্যে বেঁচে যাওয়া আলো (৩০) এখন পাগলপ্রায়। তিনি সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠতে পারলেও বাকি ছয়জন নিখোঁজ। আলো জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। নড়িয়ায় তাদের এক আত্দীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে ঢাকা থেকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের আর সেই দাওয়াত খাওয়া হলো না। তার মেয়ে মাহি (৩), মামাত ভাই শাকিল, সজীব, রুবেল, খালাত বোন সোনিয়া এবং সোনিয়ার মেয়ে সায়মন নিখোঁজ রয়েছেন।

'দেইখ্যাই বুইজ্যা ফেলাইছি ওইডা আমার বোন' : সকাল ৮টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়ে দাঁড়িয়ে এক ভাই তার বোনের লাশ উদ্ধারকারীদের হাতে দেখেই চিনে ফেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে বলতে থাকেন- 'ওইটা আমার বোন, ওইটা আমার বোন।' পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক স্বজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন আবুল কালাম। বলতে থাকেন, 'আমি হাতটা দেইখ্যাই বুইঝ্যা গেছি রে ভাই, ওইডাই আমার বোন ছাড়া কেউ না।' নড়িয়ার আবুল কালমের আহাজারিতে প্রত্যয়ের সবার নজর ফেরে তার দিকেই। বোনের প্রতি ভাইয়ের মমতামাখা দরদ দেখে অনেকের চোখ ভিজে ওঠে।

 

সর্বশেষ খবর