শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

শরীয়তপুরে আহাজারি

শরীয়তপুরে আহাজারি

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় লঞ্চডুবিতে মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনায় আহাজারি চলছে শরীয়তপুরে। লঞ্চটির হতভাগ্য যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিলেন শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। গত বৃহস্পতিবার যারা প্রিয়জনদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন, এখন তারা অন্তত লাশটি পাওয়ার আশা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন। এলাকার পুরুষ সদস্যরা বেশিরভাগই ছুটে গেছেন মেঘনার তীরে, গজারিয়ায়। যারা সেখানে যেতে পারেননি, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা অপেক্ষমাণ রয়েছেন শরীয়তপুর লঞ্চঘাটে। তারা দুই দিন ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে, শরীয়তপুর লঞ্চঘাটের পন্টুনেই। সময় পেরিয়ে যায়, লাশ পাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও যেন ক্ষীণ হতে থাকে। তাই ঘাটেই শুরু হয়ে যায় স্বজনহারাদের আহাজারি। শুধু ঘাটে নয়, নড়িয়া ও ভেদেরগঞ্জের গ্রামে গ্রামে চলছে কান্নার রোল।

পদ্মা নদীর ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর গ্রামের জালাল শিকদার দশ বছর আগে ঢাকায় আশ্রয় নেন মিরপুরের ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। স্ত্রী নাজমা বেগমও একটি গার্মেন্টে চাকরি করতে থাকেন। সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। স্ত্রী সন্তান ও পুত্রবধূ নিয়ে সুখেই তার দিন কাটছিল। দীর্ঘদিন পরে জালাল শিকদার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। সঙ্গে থাকা দেড় বছরের শিশুপুত্র আবিরও বাবার সঙ্গে না ফেরার দেশে চলে গেল। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠার কথা ছিল কিন্তু সেই আনন্দের পরিবর্তে এখন পরিবার ও পুরো গ্রামজুড়ে বইছে মাতম।

ঢাকার উত্তরা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মেহেরাজ খন্দকার (১৩) গ্রীষ্মকালীন ছুটি পরিবারের সঙ্গে কাটাতে বাড়ি ফিরছিল। বৃহস্পতিবার তার এক আত্দীয় মিরাজ ৪ লঞ্চের একটি কেবিনে তাকে তুলে দিয়ে যান। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে বাবা পিয়ারু খন্দকার তাকে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা। মেহেরাজ ৩টার দিকে তাদের লঞ্চ ঝড়ের কবলে পড়ার কথা মুঠোফোনে বাবাকে জানায়। এর কিছুক্ষণ পর থেকেই তার মুঠোফোনটি বন্ধ। এখন পর্যন্ত স্বজনরা তার কোনো সন্ধান পায়নি। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই স্বজনরা ছুটে যায় মেঘনার তীরে। বাবা পিয়ারু খন্দকার ছেলে ফিরবে এমন আশা বুকে নিয়েই সুরেশ্বর লঞ্চ ঘাটে অপেক্ষা করছেন। তিনি বারবার বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন।

শুধু পিয়ারু খন্দকার নয়, প্রিয়জনের খোঁজে এসে অনেকেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারাচ্ছেন। এ দৃশ্য যেন দেখার নয়। স্বজন হারানো মানুষের কান্নায় সুরেশ্বর ঘাট এলাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। স্বজনদের একটাই দাবি জীবিত না থাকলে মৃত লাশটা যেন দাফন করতে পারি।

তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকা শরীয়তপুর নৌপথের এমভি মিরাজ ৪ লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে ছেড়ে এসে ৩টার দিকে লঞ্চটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়। লঞ্চে থাকা যাত্রীরা ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা, নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর, সাধুর বাজার ও ওয়াপদা লঞ্চঘাটে নামার কথা ছিল। দুর্ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে ৪৫ হতে ৫০ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন এখনো নিখোঁজ যাত্রীদের কোনো তালিকা প্রস্তুত করেনি। স্বজনরা তার নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজ পেতে যাচ্ছিলেন গজারিয়ার মেঘনার তীর ও শরীয়তপুরের সুরেশ্বর, সাধুর বাজার, কাঁচিকাটা, ওয়াপদা ঘাটে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন। প্রতিটি পরিবারে চলছে মাতম। প্রিয়জনের এখনো কোনো সন্ধান না পেয়ে তারা বার বার বিলাপ করছেন।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বিকাল ৬টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে ২৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত করার পর নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ২৫টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি লাশগুলোর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি লাশের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ চাকধ গ্রামের রিপন মিয়া বলেন, আমার ভাতিজা সজীব চৌকিদার (২৪) বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে ঢাকায় গিয়েছিল। এ লঞ্চে সে দেশে ফিরছিল। ঝড়ের কবলে পড়ার পর সে ফোন দিয়ে আমাদের জানিয়েছে কিন্তু আমরা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করেছি। যেন আল্লাহ তাদের রক্ষা করে। এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ রয়েছে।

সুরেশ্বর গ্রামের মতি মিয়া জানান, আমার ভাইয়ের পরিবারের পাঁচজন এ লঞ্চে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসছিল। দুর্ঘটনার পর তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আমার ভাই জালাল শিকদার ও দের বছর বয়সের শিশুপুত্র আফসারের লাশ শুক্রবার উদ্ধারের পর আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শান্তু মিয়া জানান, আমার এলাকার কৃষ্ণ কমল দাস ও লক্ষ্মী কমল দাস নামে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রামচন্দ্র দাস বলেন, এখনো নিখোঁজদের তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন। উদ্ধার কার্যক্রম শেষ হলে নিখোঁজদের তালিকা প্রস্তুত করা হবে।

 

সর্বশেষ খবর