শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আধিপত্য বিপর্যস্ত বামেরা

শুক্রবার আলো ফোটার আগেই দিন শুরু হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। সারদা কেলেঙ্কারি, টেট কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি- এত কিছুর পরও 'মোদি-ঝড়ের' আঁচড় যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে পড়বে না, তা বোধহয় বুঝেছিল ছোট শিশুটিও। তাই বোধহয় সরু গলির ৩০-বি নম্বর বাড়িটির সামনে তৃণমূলের পতাকা হাতে সেও চলে এসেছিল মায়ের কোলে চড়ে। শুধু সে-ই নয়, দলীয় কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করেছিল সেই সাতসকালে। আর হলোও তাই। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৪টি পেয়ে বিমান বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের দুর্গকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে তুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বামেরা পেয়েছে মাত্র দুটি আসন। যেখানে কংগ্রেসের দখলে পাঁচ ও সরকার গঠন করতে যাওয়া বিজেপির দখলে গেছে দুটি আসন। ১৯৯৮ সালে দল হিসেবে আত্দপ্রকাশের পর থেকে প্রতিটি বড় নির্বাচনেই জোট করে লড়াইয়ে নেমেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কখনো কংগ্রেস কখনো বিজেপির সঙ্গে হয়েছিল সেই জোট। শেষবার ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছিল তৃণমূল। সেবার বামফ্রন্টের শাসনের শেষ পর্যায়ে তাদের সঙ্গে টক্কর দিয়েছিল দলটি। ওই সময় বামদের দুর্গ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের তছনছ করে দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন মমতা। ১৯টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল। এরপর ২০১১ সালে এলো বিধানসভা নির্বাচন। সেবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামদের ধরাশায়ী করেছিল রাজ্যের বর্তমান শাসক দল। সেদিক থেকে এবারের নির্বাচন ছিল ভিন্ন। কারণ এবার এককভাবে নির্বাচন করে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার অগি্নপরীক্ষা ছিল তৃণমূলের। সে পরীক্ষায় একেবারে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করল তারা। গতবার লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস, তৃণমূল, এসইউসিআই মিলে গঠিত জোট পেয়েছিল ২৬টি আসন। এর মধ্যে তৃণমূলের আসন ছিল ১৯টি। এবার এককভাবে লড়াই করে তৃণমূল পেল ৩৪টি আসন। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে ১৫টি আসন বেশি। বিকাল ৪টা। নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে দফতরে এলেন মমতা। সামনে তখন দেশ-বিদেশের নামি গণমাধ্যমের হুড়োহুড়ি। জননেত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে রীতিমতো শুরু হলো প্রতিযোগিতা। ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের গুঁতোয় অবস্থা কাহিল। প্রচণ্ড গরমে বারবার ঘাম মুছলেন। এরপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দলের এ জয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে উৎসর্গ করলেন তৃণমূল নেত্রী। বললেন, তৃণমূল লোভী নয়। দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে যা ভালো হবে তা-ই করবে তৃণমূল। নাম না উচ্চারণ করে রাজ্যের বিরোধী দলগুলো ও গণমাধ্যমের একাংশকে আক্রমণ করেন মমতা, 'তারা দলের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা, অপপ্রচার চালিয়েছে। কিন্তু সেই অপপ্রচার সত্ত্বেও মানুষ সমর্থন করেছে তৃণমূলকেই। মানুষই সেই কুৎসার জবাব দিয়েছে। এ জয়ে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন। ভিতরে যখন মমতা সাংবাদিকদের মুখোমুখি, বাইরে তখন 'দিদি, দিদি' বলে চিৎকার। চলছিল মিষ্টিমুখ আবার আবির খেলা। তৃণমূলের এই প্রশ্নাতীত সাফল্যে পরাজয় হয়েছে বিরোধী বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও বিজেপির বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন তারকা প্রার্থীর। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজেপির পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে আছেন বারাসাত আসনে পি সি সরকার (জুনিয়র), শ্রীরামপুরে সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী, বীরভূমে অভিনেতা জয় ব্যানার্জি, হাওড়ায় অভিনেতা জর্জ বেকার, কলকাতা উত্তরে দলের রাজ্য সম্পাদক রাহুল সিনহা আর একই আসনে কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী সৌমেন মিত্র। পরাজিত হয়েছেন তৃণমূলের বেশ কয়েকজন তারকা প্রার্থীও। দার্জিলিংয়ে সাবেক ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া, বহরমপুরে সংগীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেন ও মালদহ উত্তরে ব্যান্ডশিল্পী সৌমিত্র রায়। আর বিজেপি হাওয়ায় ভর করে আসানসোল আসনে জয় পেয়েছেন দলীয় প্রার্থী সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি পরাজিত করেছেন ৭০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে। জয় পেয়েছেন দার্জিলিং আসনে বিজেপি প্রার্থী এস এস আলুওয়ালিয়া। পাশাপাশি বাঁকুড়া আসনে জয় পেয়েছেন তৃণমূলের তারকা প্রার্থী শ্রীমতী দেববর্মা (মুনমুন সেন)। তিনি হারিয়েছেন সিপিআইএমের নয়বারের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে। ঘাটাল আসনে জয় পেয়েছেন দীপক অধিকারী দেব, কৃষ্ণনগর আসনে তাপস পাল, বীরভূম আসনে শতাব্দী রায়, বালুরঘাট আসনে নাট্যকার অর্পিতা ঘোষ, মেদিনীপুর আসনে জয়ী হয়েছেন তারকা প্রার্থী সন্ধ্যা রায়।

 

সর্বশেষ খবর