শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভারতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া

আসিফ ইকবাল
সিডনি থেকে

ভারতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া

বিরাট কোহলিকে আউট করার পর উড়ারই কথা জনসনের। সিডনিতে যে গতকাল সেমিফাইনালে ভারতের স্বপ্ন ভঙ্গ করে দেয় এই অসিরা -এএফপি

বিশ্বকাপজুড়ে ধোনির মুখে হাসি লেগেই ছিল। না হাসার কোনো কারণও ছিল না। গ্রুপ পর্বে ভারত যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল তাতে তাদের ফেবারিটের তালিকায় শীর্ষে রেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু কাল সেমিফাইনালে  মিচেল স্টার্কের বলে উমেশ যাদব বোল্ড হতেই দুহাতে চোখ বন্ধ করে ফেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। চোখ বন্ধ করে হয়তো দেখে ফেলেন নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি। যদিও ক্যারিয়ার সমাপ্তির বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। তারপরও ক্রিকেট দলের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে যাওয়ার ঘণ্টা বেজে গেল ভারতীয় অধিনায়কের!
এই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমী আর তেরঙ্গা পতাকার আধিপত্য দেখা গেল না! বিশ্বকাপ শুরুর পর যেখানেই মহেন্দ্র সিং ধোনিরা, সেখানেই হাজারো ভারতীয় এবং তেরঙ্গা পতাকা। সেই ধারা কাল থাকল না। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) সেমিফাইনালে জোর ধাক্কা খেলেন ভারতীয়রা। ধাক্কা খেলেন স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে। এসসিজির ৪০ হাজার আসনে ভাগাভাগি করে, গায়ে গা লাগিয়ে খেলা দেখেছেন দুদলের সমর্থকরা। এতেই পরিচিত পরিবেশ, আবহটা পেয়েছেন মাইকেল ক্লার্করা। পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। হাতের তালুর রেখার মতো চেনা এসসিজিতে সেই সুবিধাটুকু পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতকে কোণঠাসা করে ফের ফাইনালে উঠল টিম অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল দল অস্ট্রেলিয়া এ নিয়ে ফাইনালে উঠল সাতবার। ২৯ মার্চ ‘হার্ট অব মেলবোর্নে’ নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হতে কাল জয় পেল ৯৫ রানে।
ইতিহাস কখনো বিপরীতে হাঁটেনি। ইতিহাস কখনো হতাশ করেনি অসিদের। কালও করেনি। সেমিফাইনাল খেলে হেরেছে, এমনটি কখনো হয়নি। কাল হওয়ার কোনো সুযোগও দেননি মাইকেল ক্লার্করা। মিচেল স্টার্ক, মিচেল জনসন, হ্যাজেলওড, জেমস ফকনারদের গতি ও বাউন্সে জয় রথ থামিয়ে ভারতকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেমিফাইনাল নিয়ে বাজির দর কী রকম ছিল, জানা যায়নি। তবে ম্যাচ ঘিরে যে আবেদন সৃষ্টি হয়েছিল- এক কথায় অবিশ্বাস্য। এ বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচেই এমনটি দেখা যায়নি। এমনকি দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান কিংবা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ নিয়েও। ম্যাচটি দেখার জন্য, ইতিহাসের সাক্ষী হতে ভারত থেকে উড়ে আসেন সালমান খান, বিরাট কোহলির বান্ধবী আনুশকা শর্মা। কিন্তু দিন শেষে কেঁদেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাদের। বিশ্বকাপ কখনো জয়শূন্য অবস্থায় ফেরায়নি অসিদের। তেমনি সিডনিতে অস্ট্রেলিয়াকে নাস্তানাবুদ করতে পারেনি ভারতও। চ্যাম্পিয়ন ভারত সেমিতে এসেছিল টানা সাত জয় নিয়ে। কাল নেমেছিল অষ্টম জয়ের সন্ধানে। সে জন্য আইসিসিকে চাপ দিয়ে উইকেটও বানিয়ে নেয় নিজেদের মতো করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। উল্টো স্টিভেন ডেভিড স্মিথের ব্যাটিং তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যায় ভারতীয় বোলিংয়ের তিন কাণ্ডারি মোহাম্মদ সামি, উমেশ যাদব ও শর্মাদের গতি। তাদের গতিকে ‘ট্রাম্প’ বানিয়ে ৭ উইকেটে ৩২৮ রান করে ক্লার্কবাহিনী। যা বিশ্বকাপের ১১ আসরের সেমিফাইনালে প্রথমবারের মতো তিনশোর্ধ্ব ইনিংস এবং সর্বোচ্চ স্কোর। অকল্যান্ডের প্রথম সেমিতে ২৯৯ রান করেছিল নিউজিল্যান্ড। কাল সেই স্কোর পেরিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া স্মিথের চতুর্থ সেঞ্চুরিতে (১০৫)। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা স্মিথ এই মৌসুমে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন ৫টি। চারটিই আবার টেস্ট ক্রিকেটে এবং টানা। সব মিলিয়ে ধোনিবাহিনীর বিপক্ষে ১০ ইনিংসে স্মিথের রান ৯২১। ৩২৮ রান করার পেছনে ফিঞ্চের অবদানও কম ছিল না। ১৫ রানে ওয়ার্নার আউট হওয়ার পর তিনি স্মিথের সঙ্গে ১৮২ রানের মূল্যবান জুটি গড়ে তোলেন। এ ছাড়া শেষের দিকে জনসনের ৯ বলে ২৭ রানের ঝড়ো ইনিংস দলকে বিশাল সংগ্রহে পৌঁছে দেয়।
সিডনিতে ৩০০ রান করার ইতিহাস নেই ভারতের। আগের ১৪ ম্যাচের সর্বোচ্চ ২৯৯। তাই পরিসংখ্যানকে সাক্ষী রেখেই ফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে নামেন ক্লার্করা। আগের ১৪ ম্যাচে মাত্র একটি জেতা ভারতের বিপক্ষে এই মাঠে সর্বোচ্চ স্কোর অস্ট্রেলিয়ার ৩৫৯। ৩১৭ রান করেও এখানে জিতেছিল ১৮ রানে। তাই কাল ম্যাচের শুরু থেকেই চালকের আসনে থেকে অস্ট্রেলিয়া মাঠ ছেড়েছে হাসিমুখে। ৩২৯ রান তাড়া করে খেলতে নেমে দুর্দান্ত শুরু করে ভারতীয় দুই ওপেনার শিখর ধাওয়ান ও রোহিত শর্মা। ১২.৫ ওভারে ৭৬ রান তুলে কাঁপন ধরিয়ে দেয় অসিদের বুকে। কিন্তু ‘দিল্লির রাস্তা যে বহু দূর!’ বিবেচনায় হ্যাজলওড, স্টার্ক, ফকনারদের দুরন্ত বোলিংয়ে একের পর এক উইকেট হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। তারপরও ধোনি একাই লড়াই করে খেলেন ৬৫ রানের লড়াকু এক ইনিংস। ধোনি যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, অবিশ্বাস্য ঘটনার অপেক্ষায় ছিল ভারতীয়রা। কিন্তু প্রকৃতির বিচারে শেষ পর্যন্ত হেরেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে। অল আউট হয়েছে ২৩৩ রানে।
কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের জয় ছিল ১০৯ রানের। সাদা চোখে ব্যবধানটা বিরাট। কিন্তু সত্যি কী তাই ছিল? দুই আম্পায়ার আলিম দার ও ইয়ান গোল্ডের বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ। সেই ক্ষোভে, সেই দুঃখে কাল অধিকাংশ বাংলাদেশি সমর্থন দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে।
মাত্র এক সিঁড়ি দূরে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ২৯ মার্চ ‘হার্ট অব মেলবোর্নে’ দুই দেশ লড়বে বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে। সেই লড়াইয়ে যদি নিউজিল্যান্ড জিতেই যায় তাহলে প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরা হবে তাসমান সাগর-তীরবর্তী দেশটি। আর যদি অস্ট্রেলিয়া জিতে যায়, তাহলে ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩ ও ২০০৭ সালের পর বিশ্বসেরা হবে। কে হবে ২০১৫ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে গোটা বিশ্বকে।

সর্বশেষ খবর