নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের প্রধান আসামি নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের জড়িত থাকার বিষয়টি সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন নাসিকের কাউন্সিলর নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে নাসিকের কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পরপরই বিকালে শহীদ চেয়ারম্যান শহরের চাষাঢ়া রাইফেলস ক্লাবে এসে সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের কাছে অভিযোগ করেন, নূর হোসেন নজরুলসহ বাকিদের র্যাব দিয়ে অপহরণ করিয়েছেন। এ ঘটনায় সংসদ সদস্য নূর হোসেনকে তৎক্ষণাৎ রাইফেলস ক্লাবে ডেকে নিয়ে শাসিয়ে প্রশ্ন করেন, তুমি নজরুলকে অপহরণ করিয়েছে। জবাবে নূর হোসেন বলেন, আমি কেন এ কাজ করতে যাব, আমি তো ওকে যে কোনো সময় মারতে পারতাম। শহীদ চেয়ারম্যান জানান, প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শ্রমিক নিশ্চিত করেছেন যে র্যাবের গাড়ি দিয়েই নজরুলসহ বাকিদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৩০ এপ্রিল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে নজরুলসহ সাতজনের লাশ ভেসে ওঠে। তখন লাশের সঙ্গে র্যাবের রেশনের ডাল খাওয়ার বস্তা, কমান্ড গিঁঠ দিয়ে বাঁধা ইট দেখে সবাই বুঝে ফেলেন এ হত্যাকাণ্ড প্রশিক্ষিত কোনো বাহিনীর হাতেই হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরই প্রকাশ্যে র্যাবের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে মুখ খোলেন নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান। ১ মে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নিচ তলায় আসর নামাজের পর কয়েকজন সংবাদকর্মীকে শহীদ চেয়ারম্যান জানান, নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকায় চুক্তি করে র্যাব-১১ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সে সময় তিনি এও জানান কে কে নূর হোসেনের হয়ে এ টাকা কোন কোন ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছেন এবং র্যাবকে পরিশোধ করেছেন। সংবাদমাধ্যমে তার এ মন্তব্য প্রকাশ পাওয়ার পর শহীদ চেয়ারম্যান ‘সাত খুন নূর হোসেনের টাকার চুক্তিতে র্যাব করেছে’ বলে মন্তব্যে করেন। এতে বেকায়দায় পড়েন নূর হোসেন। লাশ উদ্ধারের এক দিন আগে ২৯ এপ্রিল শেষবারের মতো প্রকাশ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে নিজ কার্যালয়ে দেখা যায় নূর হোসেনকে। ৩০ এপ্রিল লাশ উদ্ধারের পর নিহত নজরুল ইসলামের হাজার হাজার সমর্থক চিটাগাং রোডে জড়ো হয়ে নূর হোসেনের সাম্রাজ্যে হামলা করে শিমরাইল মোড়ের অফিস কার্যালয় ও ট্রাকস্ট্যান্ডে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে নূর হোসেন তার বাহিনীসহ গাঢাকা দেন। সারা দেশে নূর হোসেনকে ধরতে প্রশাসন রেড অ্যালার্ট জারি করলেও এক বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় তিনি সীমানা পার হয়ে ভারতে চলে যান। এদিকে নূর হোসেন গাঢাকা দেওয়ায় নিহত সাত পরিবার ও সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হয়ে যায় যে, নূর হোসেন এ ঘটনায় জড়িত।
কিন্তু সবাই একটি স্পষ্ট প্রমাণের অপেক্ষায় ছিলেন যে, কীভাবে নূর হোসেন সাত খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত? এরই মধ্যে র্যাব-১১-এর সাবেক সিও তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, কোম্পানি কমান্ডার মেজর এম এম রানা ও মেজর আরিফকে র্যাব-১১ থেকে প্রত্যাহারের পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। এতে বের হতে থাকে নূর হোসেনের সংশ্লিষ্টতা। র্যাবের এ তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের পর আদালতে পর্যায়ক্রমে সাত খুনের দায় স্বীকার করে তারা জবানবন্দি দেন। কিন্তু তাদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পায় যে, র্যাব নূর হোসেনের বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল শুধু সাতজনকে হত্যাকাণ্ডের পর লাশ গুমের সময় কাঁচপুরে যেন চারদিকে সাধারণ মানুষের প্রতি নজর রাখে। কেউ যেন কাঁচপুর ব্রিজের নিচে লাশ গুমকাণ্ডে সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। কিন্তু গোমর ফাঁস হয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। র্যাবের মেজর আরিফের ফোন কললিস্ট তদন্তে বের হয়ে পড়ে থলের বিড়াল। সেখানে দেখা যায়, মেজর আরিফ নূর হোসেনর সঙ্গে সাতজনকে অপহরণ, হত্যার পর লাশ গুম পর্যন্ত দুপুর ১২টা থেকে গভীর রাত অবধি ১৫-২০ বারের মতো কথোপকথন করেছেন। সেই কথোপকথনের রেকর্ডে নূর হোসেনের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়। এ ছাড়া নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগীকে গ্রেফতারের পর আদালতে জবানবন্দিতে তিনি জানান, নূর হোসেন ২৭ এপ্রিল অপহরণের দিন তাদের একটি মাইক্রোতে করে র্যাবকে নজরদারিতে রেখেছিলেন এবং সাতজনকে হত্যার পর লাশ গুমের সময় কাঁচপুরে র্যাবকে নিরাপত্তা দিতে তাদের বিশাল বাহিনীকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সঙ্গে র্যাবকে রেকি করিয়েছেন যে, র্যাব অপহরণ থেকে শুরু করে লাশ গুমের কাজটি সঠিকভাবে করছে কিনা। ওই জবানবন্দিতে নূরের সহযোগী আরও বলেছেন, লাশ গুমের পর রাত ২টায় নূর হোসেন সবাইকে তার সিদ্ধিরগঞ্জের ট্রাকস্ট্যান্ডে ডেকে আনেন। পরে সবাইকে চলে যেতে বলে ঘনিষ্ঠ পাঁচ-ছয় জনকে বাসায় নিয়ে যান। বাড়ির দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নূর হোসেন হঠাৎ ‘খ’ উচ্চারণ করে গালি দিয়ে বলেন, ‘নজরুলরে দুনিয়ার তে উডাইয়া দিছি। যা এবার তোরা আরামে গিয়া ঘুমা।’ জবানবন্দিতে নূর হোসেনের সহযোগীর এ রকম স্বীকারোক্তিতে সাত খুনে নূর হোসেনের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পায়। এ ছাড়া র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মেজর আরিফের মোবাইল কললিস্ট খতিয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে তার কথোপকথনে সাত খুনে জড়িত থাকার অসংখ্য প্রমাণ পেয়েছেন।এদিকে নূর হোসেনকে বেনাপোলে হস্তান্তর করা হয়েছে এমন সংবাদের ভিত্তি জানতে চাইলে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী নাসিকের কাউন্সিলর সেলিনা ইসলাম বিউটি জানান, ‘আমাদের সাতটি পরিবার শুধু একটি বিষয় জানতে চাই, শুনতে চাই নূর হোসেনের মুখ থেকে। কী কারণে সে এভাবে সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সাতটি পরিবারকে ধ্বংস করেছে। তার মুখ থেকেই শুনতে চাই, কেন ছিল তার জিদ, রাগ, ক্ষোভ।’