শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সেদিন যা হয়েছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাত তখন ২টা। মালিবাগের চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাটের প্রত্যেকেই গভীর ঘুমে। নিজ ঘর অন্ধকার করে শুধু জেগে আছে ওই বাসার কিশোরী মেয়ে ঐশী। হঠাৎ ঐশী তার নিজ আলমারি খুলে একটি ধারালো খঞ্জর বের করে আনে। খঞ্জরটি নিয়ে মায়ের রুমে যায়। ঐশীর দেওয়া ঘুমের ওষুধ মেশানো কফি খেয়ে  মা তখন গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত মায়ের ওপর হঠাৎ হামলে পড়ে সে। প্রথম আঘাতেই তার মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। শরীর থেকে রক্ত বেরোতে থাকে। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। শুধু গোঙানির শব্দ। মা খুব কষ্ট করে বলতে থাকেন, ‘ঐশী! কী করছিস! তুই আমার মেয়ে না।’ ধারালো খঞ্জরের এলোপাতাড়ি আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন মা। এক পর‌্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। ছোট ছেলে ঐহী মায়ের সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল। তারও ঘুম ভাঙে। ঐশী তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর ঐশী এগিয়ে যায় ঘুমিয়ে থাকা তার বাবার কাছে। বাবার গলায় খঞ্জর চালাতে থাকে। একবার নয়, বার বার। একাধারে সে তার বাবার গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে খঞ্জর চালাতে থাকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো কফি খাওয়ার কারণে তিনি কোনো প্রতিরোধ করতে পারেননি। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। পরে কাজের মেয়ে সুমির সহায়তায় সে তাদের লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে টেনে হিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে ফেলে রাখে।

২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট রাতে এভাবেই ঐশী তার বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করে; যা পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। খুনের পর বাথরুমে লাশ দুটি রেখে ঘর থেকে সে পালিয়ে যায় ছোট ভাইসহ কাজের মেয়েকে নিয়ে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ওই ফ্ল্যাট থেকে ঐশীর বাবা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি হয়েই পাল্টে যায় কিশোরী ঐশী। বেপরোয়া জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত প্রেম ও মাদক সেবনে ডুবে যায় সে একসময়। এতে বাধা দেন তার বাবা-মা। আর তাতেই খেপে যায় ঐশী। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করে নিজের বাবা-মাকে হত্যার কথা। স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, আগের রাতে কোনো একসময় কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করে ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সী ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে যায়। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে এক দিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আÍসমর্পণ করে এই কিশোরী। পরে তার বক্তব্যের সূত্র ধরেই রনি ও জনিকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। ঐশীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। সেখানকার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন তার ভালো লাগেনি। তখন থেকেই তার ধারণা জম্নে ওই স্কুলে লেখাপড়া করলে পার্থিব জীবনের সব সৌন্দর্য উপভোগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধারণা থেকে স্কুল বদল করতে বাবা-মাকে চাপ দিতে থাকে। বায়না ধরে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তির। ঐশী ছিল বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। তাই তার সব আবদার পূরণের চেষ্টা করতেন বাবা-মা। যা চাইতেন তা-ই দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এরই এক পর‌্যায়ে ২০১১ সালে ঐশীকে ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দেন। ভর্তির পর স্কুলের গাড়িতেই যাতায়াত করত ঐশী। মাঝেমধ্যে রিকশা নিয়ে যেত। সেখানে ভর্তির পরই ঐশীর আচরণ ও জীবনযাপনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণে কখনো কখনো তার মা বকাঝকা করতেন। স্কুলের কথা বলে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনো রাত ১০টা, কখনো ১১টায় ফিরত। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিত ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। যোগ দিত ইয়াবা ও গাঁজার আসরে। এসব আড্ডার আসরেই পরিচয় হয় পুরান ঢাকার ডিজে জনির সঙ্গে। তার সঙ্গে কিছু দিন মেলামেশার পর তারই বন্ধু রনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এ রনি ও জনির মাধ্যমেই মূলত নেশার জগতে প্রবেশ করে ঐশী। তেমনই একজন প্রেমিক পারভেজ। মূলত এ পারভেজের নির্দেশনা মোতাবেক ঐশী পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করে। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, এক পর‌্যায়ে ঐশীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেন মা। তার পর থেকে বন্ধুমহলের সঙ্গে যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ঐশী। তখন তার কাছে নিজের বাবা-মাকেই প্রধান শত্র“ বলে মনে হয়। কখনো নিজেকে শেষ করার, আবার কখনো বাবা-মাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে সে। এক পর‌্যায়ে ঐশী ১২ পৃষ্ঠার সুইসাইডাল নোট লিখে বাসায় রেখে দেয়। লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন আলামতের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঐশীর হাতে লেখা ওই চিঠি উদ্ধার করেছে। সেখানে তার জীবনের সুখ, দুঃখ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করেছে। নিজেকে খারাপ প্রকৃতির মেয়ে হিসেবে দাবি করার পাশাপাশি কেউ তার কষ্ট বুঝতে চায়নি বলেও দাবি করেছে। আর এ কারণেই আত্নহত্যার মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের পরিকল্পনার কথা উলে­খ করেছে। অবশ্য ঐশী আত্নহত্যা না করে পরে তার বাবা-মাকেই হত্যা করে। গোয়েন্দারা জানান, নিজের বাবা-মাকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি ঐশী। আলমারিতে রক্ষিত স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। হত্যার আগে সন্ধ্যার পর মায়ের জন্য তৈরি করা কফিতে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়। মা ঘুমিয়ে পড়লে তার সঙ্গেই শুয়ে থাকে ঐশী। রাত ১১টার পর তার বাবা বাসায় ফিরলে তাকেও ঘুমের ট্যাবলেট-মিশ্রিত কফি খেতে দেয়। তিনিও ঐশীর বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপরই ঘটে সেই রোমহর্ষক জোড়া খুন; যা সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

সর্বশেষ খবর