মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঠাঁই নেই কারাগারে

সাখাওয়াত কাওসার

ঠাঁই নেই কারাগারে

জেল কোড অনুযায়ী প্রত্যেক বন্দীর জন্য জায়গা বরাদ্দ ৩৬ বর্গফুট। সে অনুযায়ী দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ৪৬০ জন। অথচ গতকাল পর্যন্ত ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭৮ হাজার ৮২২ জন। তিল ধারণের ঠাঁই না থাকলেও প্রতিদিনই বাড়ছে বন্দীর সংখ্যা। এ অবস্থায় মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি রীতিমতো নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে কারা প্রশাসনে। মাত্র কদিন আগেই দেশের সব কটি কারাগারে জারি করা হয়েছিল বিশেষ সতর্কতা। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৫ নভেম্বর থেকে বিশেষ অভিযান অব্যাহতভাবে চলার কারণে প্রতিদিনই কমপক্ষে ১ হাজার বন্দী যোগ হচ্ছেন দেশের সব কটি কারাগারে। অথচ বন্দী ব্যবস্থাপনার জন্য বাড়ছে না বাজেট। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রÑআসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে অনেককেই কেবল দলীয় পরিচয়ের কারণে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পেন্ডিং মামলায় তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ময়লার ট্রাকে আগুন দেওয়ার অভিযোগেও রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থাতেই কারাগারে ধারণক্ষমতার অধিক বন্দী থাকেন। বন্দী ব্যবস্থাপনার জন্য যতটুকু বাজেট থাকা দরকার তা নেই। এতে করে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে, যা সত্যিই আশঙ্কার কারণ। নিরাপত্তার বিষয়টি উলে­খ করে নূর খান বলেন, কারান্তরীণ জঙ্গিরা নতুন বন্দীদের তাদের আদর্শে উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাবেন এটা ধরেই নেওয়া যায়। এটা পরবর্তী সময়ের জন্য নানাবিধ সমস্যা ডেকে নিয়ে আসতে পারে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গতকাল পুলিশ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কেবল তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। একে গণগ্রেফতার বলা ঠিক হবে না।

এদিকে গ্রেফতার হওয়া পল­বী থানার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হাজী আবু তৈয়ব সম্পর্কে জানা গেছে, সম্প্রতি তিনি হজ করে এসেছেন। হজে থাকা অবস্থায়ই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে মদদ দিয়েছিলেন বলে একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। হজে থাকার প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুলিশকে দেখানোর পরও তার রেহাই মেলেনি। এর বাইরেও সম্প্রতি নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজের সাবেক ভিপি ও নোয়াখালী বিএনপি নেতা মঞ্জুরুল আজিম সুমন নিæ আদালতে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তাকেসহ ২০ জনকে একাধিক পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।

কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বন্দী রয়েছেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো বন্দী ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছি। নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। এ জন্য আমরা কারাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছি। কারাগারগুলোতে সার্চ লাইটিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কারারক্ষীরা বর্তমানে বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট পরে ডিউটি করছেন। সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা ও কাশিমপুরসহ বিভিন্ন কারাগারে থাকা বন্দীর মধ্যে সাধারণের পাশাপাশি বিডিআরের বিদ্রোহী সদস্য, জামায়াত-শিবির ক্যাডার, শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ জঙ্গি এবং যুদ্ধাপরাধীও রয়েছেন। বন্দীর বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলসংশ্লিষ্ট। গত কয়েক মাসে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই নাশকতা কিংবা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত। ঢাকা ও কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, একই স্থানে থাকার সুবাদে সমমনা দলীয় বন্দীরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছেন। কারা কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির কারণে তারা প্রকাশ্যে কিছু করতে পারছেন না। তবে গোপনে প্রতিদিন শলাপরামর্শ চলছে। সূত্র আরও জানায়, সব কারাগারেই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী রয়েছে। দুই থেকে চার গুণ বেশি বন্দীও রয়েছে কোথাও কোথাও। জেল কোড অনুযায়ী একজন সাধারণ বন্দীর জন্য ৩৬ বর্গফুট স্থান থাকার কথা। কিন্তু এ কোড মানা হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন বন্দীর জন্য বরাদ্দ থাকা স্থানকে কয়েকজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যাও প্রকট। বন্দীরা থাকছেন গাদাগাদি করে। এত বন্দী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বশীলরা। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মেঘনা-৫ সেলের বন্দীর বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। ইতিমধ্যে এ সেলটি জামায়াত-শিবিরের সেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তিনি বলেন, মেঘনা-৫-সহ কয়েকটি সেলে প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর জামায়াত-শিবিরের বন্দীরা গোল বৈঠক করেন। বৈঠকে সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি জানান, জামায়াত-শিবিরের নতুন কোনো বন্দীকে অন্য সেলে রাখা হলে, কারারক্ষীদের ম্যানেজ করে তারা মেঘনা-৫ সেলে চলে যান। কারণ এ সেলের বন্দীদের আদর-যতœ বেশি হয়। তিনি আরও বলেন, কারাগারের ভিতর বিদ্রোহ করার পরিবেশ নেই। তবে বাইরে এসে কী কী করতে হবে সে পরিকল্পনা কারাগারের ভিতরই করা হচ্ছে। জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দী ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৬৫০ জন। গত রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কারাগারে ৮ হাজার ১৭ জন বন্দী ছিলেন। স্থানসংকুলান না হওয়ায় শুক্র ও শনিবার ৪২৭ জন বন্দীকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠায় কর্তৃপক্ষ। এদিকে, সাবেক কারা উপ-মহাপরিদর্শক মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তরিকতা থাকলে বন্দী ব্যবস্থাপনা খুব কঠিন কাজ নয়। সরকার চাইলে দ্বিতলবিশিষ্ট খাটের ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলেও অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করে দ্বিগুণ বন্দী রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমরা দায়িত্বে থাকাকালে যখন বেশি বন্দী আসত তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে মাল্টিপারপাস হল এবং বিভিন্ন গোডাউন খালি করে বন্দী রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, বন্দীর বাড়তি চাপ থাকলেও তাদের থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। কখনো বন্দী বেড়ে গেলে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। নিরাপত্তাব্যবস্থারও কোনো ঘাটতি নেই। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরও সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, কারাগারের বাইরে সশস্ত্র কারারক্ষীদের টহল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া সিসিটিভি ও অবজারভেশন পোস্ট থেকে নজরদারি করা হয় সার্বক্ষণিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর