রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এই প্রথম ফাঁসি সাবেক মন্ত্রীর

মাহমুদ আজহার

বাংলাদেশের ইতিহাসে গতকালই প্রথম দুজন প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতার এক রাতে একই সময়ে ফাঁসি কার্যকর হলো। গত রাত পৌনে ১টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে একজন হলেন এইচ এম এরশাদ জমানার প্রভাবশালী স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও অন্যজন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এই দুজনই বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দল ও জোটে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টাও ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। একইভাবে মুজাহিদও বিএনপি-জামায়াতে সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ২০০৮ সালে চারদলীয় জোটকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মুজাহিদের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে বিএনপি এখনো ভুল বলে মনে করে। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের দুই নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়, যাদের কেউই মন্ত্রী বা এমপি হননি। এ ছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক গুরু মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামি অধ্যাপক গোলাম আযম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। জামায়াতের নায়েবে আমির সাবেক এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম সাজা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে জামায়াতের আমির সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির সাবেক এমপি আবদুস সুবহান, জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম, মীর কাসেম আলী, জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক এমপি আবদুল জব্বার, সৈয়দ মো. কায়সার, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজাকার মাহিদুর রহমান।

কারাসূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে ৪১১ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পাঁচ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এদের মধ্যে একজন অবশ্য সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া এ পর্যন্ত ৩৬ জন মহিলাকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও তাদের কারও দণ্ড কার্যকর করা হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, তাদের সবাই পুরুষ। ফাঁসির তালিকায় এখনো কমপক্ষে এক হাজার ২০ জন অভিযুক্তের নাম রয়েছে।

রাজনৈতিক পালাবদলে রাজাকার সাকা : রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেছেন সাকা। ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে প্রথমবারের মতো রাউজানের এমপি নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি  থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিন্তু পরে এরশাদ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। সেখান থেকে বের হয়ে ১৯৮৮ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে নিজেই একটি দল গঠন করেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে নিজের এই দল থেকেই ফের রাউজানের এমপি নির্বাচিত হন। আধিপত্যশীল এই নেতা পরে নিজের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। সব মিলিয়ে ছয়বার সংসদ সদস্য হন এই রাজাকার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী। জীবনভর তার কথাবার্তার ধরন ছিল লাগামছাড়া। শুধু রাজনৈতিক মহলই নয়, সারা দেশের মানুষও তার শিষ্টাচারবিবর্জিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা জানত। এমনকি তার নিজ দলের প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে নিয়ে অশালীন বক্তব্য দেওয়ায় ২০০১ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস পরই নির্বাচনের আগে আবার তাকে দলে ডেকে নেয় বিএনপি। এ নিয়ে দলের বড় একটি অংশই তাকে চোখের কাঁটা হিসেবে দেখত। আত্মীয়তা ও পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সূত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন সাকা।

আলবদর প্রধান থেকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তিনি ২০০১-২০০৬ সময়কালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধারে গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেন। ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জনের মাত্র দুই দিন আগে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে তিনি অভিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে মুজাহিদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট এবং রাজাকার বাহিনীর স্থপতি, আলবদর প্রধান। স্বাধীনতাযুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে তিনি রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মুজাহিদ ছিলেন আলবদরের সামরিক ও অর্থনৈতিক মূল চালিকাশক্তি। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া। তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা। ১৯৬৪ সালে মুজাহিদ ভর্তি হন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘে যোগ দেন তিনি। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। স্বাধীনতার পর পলাতক ছিলেন। ১৯৮২ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন তিনি। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে দলের সেক্রেটারি জেনারেল হন মুজাহিদ।

সর্বশেষ খবর