শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শাহজালাল বিমানবন্দর নিরাপত্তা হুমকিতে

লাকমিনা জেসমিন সোমা

নাশকতার আশঙ্কায় সরকারের ‘কঠোর নজরদারি’ সত্ত্বেও চরম নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কাস্টমস কিংবা কার্গো বিভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র বিমানবন্দরের কোথাও এমন কোনো স্ক্যানার মেশিন  নেই যেটি দিয়ে বিস্ফোরক, মাদক কিংবা কেমিক্যাল দ্রব্য শনাক্ত করা যায়। গত মাসেই বিমানবন্দর পরিদর্শনে এসে ব্রিটিশ এভিয়েশনের একটি গোয়েন্দা দল বিমানবন্দরের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে  ‘উদ্বেগজনক’ বলে রিপোর্ট করে গেছে। এ ঘটনার পর গত ২২ নভেম্বর ফের ব্রিটিশ হাইকমিশনার উইলিয়াম রবার্ট গিবসন বলাকা ভবনে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বিস্ফোরক দ্রব্য পাচার রোধে অত্যাধুনিক ডিভাইস সিস্টেম চালুসহ ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের দেওয়া নির্দেশনা ও শর্ত মানা না হলে ঢাকা থেকে লন্ডনের সরাসরি ফ্লাইটটি বন্ধ করে দেওয়ারও আভাস দেওয়া হয়েছে।

কেবল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাই নয়, খোদ সিভিল এভিয়েশন, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ (এপিবিএন) নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অন্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও একই শঙ্কার কথা বলছেন। গত ১০ নভেম্বর কাস্টমস বিভাগের সম্মেলন কক্ষে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোটির নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন তারা। এতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, কাস্টমস কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এসব ঘটনার পর গেল সপ্তাহে কেমিক্যাল ও বিস্ফোরক শনাক্তকরণ স্ক্যানার মেশিন কেনার জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে বিমানবন্দর কাস্টমস বিভাগ। কাস্টমস বিভাগের সহকারী কমিশনার শহীদুজ্জামান ও এপিবিএনের সিনিয়র এএসপি আলমগীরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাশকতার আশঙ্কা সত্ত্বেও শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রীদের মালামাল পরীক্ষার জন্য কোনো আধুনিক স্ক্যানার নেই। কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য কাস্টমস বিভাগে নেই নিজস্ব ল্যাবরেটরি। তারা যে স্ক্যানার ব্যবহার করেন সেগুলোতে কেবল ধারালো অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি এবং স্বর্ণ শনাক্ত করা যায়। শহীদুজ্জামান বলেন, স্ক্যানারে যখন কোনো কিছু পাউডার হিসেবে শনাক্ত হয়, তখন বোঝা যায় না যে, এটি নরমাল পাউডার নাকি গানপাউডার। তবে সন্দেহ হলে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি বা অন্য কোনো প্রাইভেট ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠান। আর মাদক বিষয়ে সন্দেহ হলে সেগুলো পাঠান মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে। অর্থাৎ, ম্যানুয়াল চেকিংয়ে ধরা না পড়লে যে কেউ ইচ্ছা করলেই এসব নিয়ে অবাধে বিমানবন্দরে ঢুকতে বা বের হয়ে যেতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বিস্ফোরক, মাদক ও লিকুইড দ্রব্য শনাক্তকারী স্ক্যানার না থাকার কথা স্বীকার করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খুব শিগগিরই এ ধরনের স্ক্যানার নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশ বিমানের ব্যাপারে শঙ্কার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে বিমানের লন্ডন ফ্লাইট বন্ধের আভাস দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন বিমানমন্ত্রী।

এদিকে টার্মিনালের ভিতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাত্রীদের চেকিংয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নির্ধারিত টার্মিনাল দিয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকেই প্রথম যে স্ক্যানিংটি হয়, সেটিতে অনেক সময় স্ক্যানার মেশিনের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা খেয়ালই করেন না। অন্যদিকে এয়ারলাইনসের টিকিট কাউন্টারে চেকিংয়ের সময় লাগেজের ওজন ছাড়া অন্য কিছু পরীক্ষা করা হয় না। এরপর বিমানে ওঠার আগে শেষ ধাপে এসে যখন যাত্রীর শরীর ও তার হ্যান্ড লাগেজ তল্লাশি করা হয়, সেটিও হয় সাধারণ প্রক্রিয়ায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাস্টাররোলের অস্থায়ী অদক্ষ কর্মীরা এসব চেকিং করে থাকেন। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের (এপিবিএন) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ বিমানবন্দরে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) মানদণ্ড অনুযায়ী জনবল দিয়ে বিশেষ সিকিউরিটি ফোর্স গঠন করে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। কিন্তু এখানকার এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তা না করে কেবল খরচ বাঁচাতে চায়। তাছাড়া বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশন উভয়ই চায় তাদের স্ব স্ব বিমানবাহিনীর লোকজন দিয়ে এই সিকিউরিটি ফোর্স গঠন হোক, পুলিশ সদস্য দিয়ে নয়। আজকের নিরাপত্তা সংকটের পেছনে বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট ১৮টি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করেন এই কর্মকর্তা। সরেজমিন দেখা গেছে, বিমানবন্দরে কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও অবাধে ঢুকছে লোকজন। কখনো ভিআইপি পরিচয়ে, আবার কখনো বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট স্টাফ পরিচয় দিয়ে টার্মিনালে প্রবেশ করছে অপরিচিত মুখ। এ ছাড়া টার্মিনালের সামনে, পেছনে, পার্কিং  এলাকায়, পার্কিং ভবনে, কার্গো কমপ্লেক্স বা কার্গো ভিলেজে, বিএফসিসি ও ভিআইপি গেট সংলগ্ন এলাকায় এবং কাস্টমস ভবন ঘিরে ও এর আশপাশের এলাকায় অবাধে বিচরণ করছে লোকজন। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বিমানবন্দরে অবাধে বিচরণের সুযোগ এতটাই বেশি যে, হাতে একটি ওয়াকিটকি নিয়ে যে কেউ ইচ্ছা করলেই স্টাফ সেজে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত অবাধে ঘুরে আসতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শী এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের (এপিবিএন) একজন সদস্য বলেন, বিমানবন্দরের সীমান্ত দেয়াল এলাকা বা নিরাপত্তা চৌকিতে নিরাপত্তা কর্মী থাকে না। বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর এলাকার প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। সেখানে অবাধে গরু-ছাগল ঢুকছে। এমন কি প্রায়ই ওইসব এলাকার দেয়াল টপকে স্থানীয়রা ঢুকে পড়ছেন বলেও জানান তিনি।

‘কঠোর নিরাপত্তা’র মধ্যেও সক্রিয় চোরাচালান সিন্ডিকেট : কথিত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও সক্রিয় রয়েছে অবৈধ চোরাচালান সিন্ডিকেট। কার্গো ভিলেজে কর্মরত কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ ১৮টি সংস্থার অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা নিয়েই চলছে সোনা চোরাচালান ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার। সরেজমিন এসব সিন্ডিকেটের লাইসেন্সধারী অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের আনাগোনা দেখা গেছে। রেড অ্যালার্ট জারির মধ্যেই গত দুই মাসে কমপক্ষে ১০০ কেজি সোনা ও সাড়ে তিন কোটি ভারতীয় রুপি উদ্ধার করেছে কাস্টমস বিভাগ। যার পুরোটাই বিদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া। এ ঘটনার পর বিদেশিদের ওপর নজরদারি বাড়াতে একটি আলাদা টিমও গঠন করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের উদ্বেগ, ছোটাছুটি ও পেছনের কারণ : গত ১১  নভেম্বর ব্রিটিশ এভিয়েশন গোয়েন্দা দল বিমানবন্দর পরিদর্শন শেষে জানায়, সম্প্রতি মিসরে রাশিয়ান উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের মূল কারণ ছিল প্লাস্টিক বোমা। শাহজালালের স্ক্যানিং মেশিনে এ ধরনের বোমা শনাক্তকরণে কোনো প্রযুক্তি নেই। এরপর ১৬ নভেম্বর তিন সদস্যের অপর একটি ব্রিটিশ দল তাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে দেয়। প্রতিবেদনে উদ্বেগের অন্যান্য কারণ হিসেবে কার্গো কমপ্লেক্সে বিমানের নিজস্ব জনবল না থাকা, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) মানদণ্ড অনুযায়ী জনবল দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালনা না করা, বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হ্যাংগার ও দোকানপাট বসানোসহ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়। এরপর ২২ নভেম্বর হঠাৎ করেই বাংলাদেশ বিমানের বলাকা কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা ও লন্ডনে ফ্লাইট পরিচালনার কিছু শর্ত নিয়ে হাজির হন ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার উইলিয়াম রবার্ট গিবসন। এর দুই দিন পর ফের নিরাপত্তা বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে মিন্টো রোডের বাসায় সাক্ষাৎ করেন গিবসন। এরপর দফায় দফায় বৈঠক করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নতুন কিছু পদক্ষেপ নেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বিএফসিসির খাবার উড়োজাহাজে উঠানোর আগে ও পরে সিলগালা করে নেওয়া, খাবার স্টাফদের ভালো করে তল্লাশি করা, যাত্রীদের একাধিক স্তরে তল্লাশি চালানো, ইউরোপিয়ান নাগরিকদের লাগেজ আলাদা স্তরে সাজানোসহ প্রভৃতি। এদিকে এপিবিএনের একটি সূত্র বলছে, ব্রিটিশদের পরামর্শ ও শর্ত পূরণে বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা থেকে সরাসরি লন্ডন ফ্লাইট বন্ধ না করতে আগেই বিমানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে সিলেটবাসী। প্রসঙ্গত, কিছু দিন আগে নাশকতার আশঙ্কায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সবকটি বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিশেষ করে সম্প্রতি দুজন বিদেশি নাগরিক ও দুজন ব্লগার হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনার পর বিমানবন্দরে মোতায়েন করা হয় র‌্যাব ও বিজিবির ডগ স্কোয়াড। দর্শনার্থী প্রবেশ থেকে শুরু করে যাত্রীদের তল্লাশি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি।

সর্বশেষ খবর