শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রণাঙ্গনে শত শত শহীদের লাশ দাফন হতে দেখেছি

মুসা সাদিক

রণাঙ্গনে শত শত শহীদের লাশ দাফন হতে দেখেছি

১৯৭১-এ ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডো যোদ্ধা এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপনডেন্ট’হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করি। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যশোরের চাঁচড়ায় হানাদার পাক বাহিনীদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। তারা বর্বর নির্যাতন করে নির্জীব মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত ভেবে আমাকে অন্যান্য মৃতদেহের মধ্যে ফেলে রেখেছিল। তারা পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেখানে অকস্মাৎ মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি শেলিং শুরু হলে হানাদার বাহিনী দ্রুত রিট্রিট করলে লাশের স্তূপ থেকে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা জীবন্মৃত অবস্থায় আমাদের দুজনকে উদ্ধার করেন। আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই। সবই আল্লাহর অসীম কুদরত। মুক্তিযুদ্ধে আমার দুঃসাহসিক ঝুঁকিপূর্ণ অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়ে প্রবাসী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখে রেখে গেছেন, ‘৯ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে তিনি একজন দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরে কালিন্দী নদীতে কয়েকটি পাক হানাদার লঞ্চ দখলের যুদ্ধে জনাব মুসা অসীম সাহসিকতার নজির স্থাপন করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘সমর সংবাদদাতা’ নিয়োগ করা হয়। সংবাদদাতার কাজের পাশাপাশি ফ্রন্টে পাক পজিশন ও ডিফেন্সের তথ্য সংগ্রহের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। এ চ্যালেঞ্জিং কাজে যখন কাউকে পাওয়া যায়নি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনাব মুসা হাসিমুখে এ দায়িত্ব পালনের শপথ নেন। পাক হানাদারদের চোখ এড়িয়ে বহুবার জীবন-মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তিনি এ কাজে শঙ্কিত বা ভীত হয়ে পড়েননি।’ ’৭১-এর শহীদি দরজা থেকে ফিরে পরবর্তীকালে আমি মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনটি বই লিখেছি এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা নিয়মিত লিখে যাচ্ছি। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি ৯ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন শাহজাহানের নেতৃত্বে একজন কমান্ডো যোদ্ধা হিসেবে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করি। পরবর্তীতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপনডেন্ট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। রণাঙ্গনে শত শত  শহীদের লাশ আমি দাফন হতে দেখেছি। ৩০ লাখ শহীদের পূতপবিত্র লাশের ওপর গড়ে ওঠা বাংলাদেশে কি তাদের স্বপ্ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন আজও পূরণ হয়েছে? নির্মোহচিত্তে ও নির্ভীকপ্রাণে আমি ৪৪ বছর পর কঠিন সত্য উচ্চারণ করে বলি, ৩০ লাখ বীর শহীদের স্বপ্নের এক কণাও পূরণ হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। সাড়ে ৩ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। তিন লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা বোনের দীর্ঘশ্বাস চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার ও ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দীন স্যারদের হত্যার পর বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী রাক্ষস-খোক্ষসেরা চার বছরের শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবৈধ অভিভাবকত্ব পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে খাবলে খেয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, শহীদ পরিবারদের নিগৃহীত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পদানত ও নিকৃষ্ট করে দেখানোর জন্য তারা পাকিস্তানের চেয়েও অধিক জঘন্য ইসলামী জঙ্গি দেশে রূপান্তরিত করেছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের বুকে সাড়ে ৭ কোটি লোকের হাতে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যে মহান বিজয়ের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল- বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস সাড়ে ৭ কোটি কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছিল; মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সেই বাংলাদেশ গত ৪৪ বছরে ধূসর, ম্রিয়মাণ ও দুর্নীতির কালো কফিনে ঢেকে গেছে! বিশ্ব মানব জাতির চোখে বাংলাদেশ আজ চরম দুর্নীতিবাজ একটি দেশ। ’৭১-এ বিশ্ব মানব জাতি ও আরব বিশ্ব ‘৩০ লাখ শহীদের দেশ’ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়-ভক্তিতে অভিবাদন জানাত; আজ সেই বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব মানব জাতি শ্লেষে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবু দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিতে হবে। একদিন উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে আমাদের দেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট।

সর্বশেষ খবর