রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কেউ মানছে না আচরণবিধি

গোলাম রাব্বানী

কেউ মানছে না আচরণবিধি

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা নির্বাচনে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে মনোনয়নপত্র জমাদান পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপিরা নিজ নিজ মেয়র প্রার্থীর পক্ষে বিধি লঙ্ঘন করে মনোনয়নপত্র জমা দিতেও গেছেন। এমনকি একজন এমপি হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিলেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে। ক্ষমতাসীন দলের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় উত্কণ্ঠা বিরাজ করছে বিভিন্ন পৌরসভায়। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিভিন্ন পৌরসভায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক প্রার্থী। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন দেখেও না দেখার  ভান করে হাত গুটিয়ে বসে আছে। এখন পর্যন্ত ইসিকে কঠোর কোনো পদক্ষপ নিতে দেখা যায়নি বলে অভিমত দিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, নির্বাচনের প্রথম দিকেই যদি এমন হয় তাহলে ভবিষ্যতে আরও কী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া একেবারেই অযৌক্তিক নয়। এমন চলতে থাকলে মানুষ নির্বাচনের প্রতি অনীহা দেখাতে পারে। এ ছাড়া সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিরপেক্ষ না হয় তাহলে অর্থবহ নির্বাচন হবে না।

বরগুনা-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন বেতাগী পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে হেলিকপ্টারে বেতাগী গিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার নিয়ে এমপি বেতাগী হাইস্কুল মাঠে অবতরণ করেন। সেখান থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে শোডাউনসহ উপজেলা চত্বরে এমপির অফিসে এসে মেয়র প্রার্থী এ বি এম গোলাম কবিরের হাতে মনোনয়নপত্র তুলে দেন। নির্বাচনী এলাকায় এমপির হেলিকপ্টারে আসার ঘটনায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করছেন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য মেয়র প্রার্থীরা। এ বিষয়ে বেতাগী পৌরসভার রিটার্নিং অফিসার দুলাল তালুকদার বলেন, এমপি কীভাবে এসেছেন আমি দেখিনি।

একইভাবে বাধার কারণে পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি অনেক মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী। এমনকি মনোনয়নপত্র না নিতে কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে চাঁদপুরের মতলব ও চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, কুমিল্লার দাউদকান্দি ও ফেনীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পৌরসভা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই নির্বাচন কমিশনে (ইসি) প্রার্থীদের অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করেছে। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমায় বাধাদান মূলত নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন বলেও মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নাসির উদ্দিনের বাড়িতে দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে বলে ইসিতে অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নাসির উদ্দিন বাড়িতে ছিলেন। হামলার পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িকের পর নির্বাচন কমিশনের চুপচাপ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, প্রথমদিকেই যদি এমন হয় তাহলে ভবিষ্যতে আরও কী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া একেবারেই অযৌক্তিক নয়। এমন চলতে থাকলে মানুষ নির্বাচনের প্রতি অনীহা দেখাতে পারে।

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলের যেহেতু নির্বাচন সেখানে নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। তবে আইনের শাসন গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী যেসব আইনকানুন আছে তা নির্বাচন কমিশন, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল সবাইকে মানতে হবে। কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক দেখা গেল। দেখা গেল, সাভারে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে এমপি গেলেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে। রিটার্নিং অফিসারও কোনো রকম বাধা না দিয়ে তা গ্রহণ করলেন। ফেনীতে দেখা গেল ৩৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলেন। ধামরাইয়েও এমপি গেলেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে। বরগুনাও একই ধরনের ঘটনা ঘটল। এমন ঘটনা হয়তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর নয়, কিন্তু উদ্বেগজনক হলো নির্বাচন কমিশনের চুপচাপ থাকা। ক্ষমতা নিয়ে বসে থেকেও কমিশন কেন চুপচাপ তা একটি প্রশ্ন। তিনি বলেন, এমপিরা নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকবেন না, তা কেন্দ্রীয়ভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিয়েছে। আবার সরকারি গাড়ি ব্যবহার সব সময়ই নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। তাই এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের চুপচাপ থাকা সংশয়ের সৃষ্টি করে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সরকারের প্রধানতম দুই অংশ— প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যদি নিরপেক্ষতা প্রদর্শন না করে তাহলে নির্বাচন কমিশন চাইলেও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে না। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সমাজের সব স্তরের প্রতিনিধিদের কর্তব্য আছে। কিন্তু সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিরপেক্ষ না হয় তাহলে কোনো লাভই হবে না। সরকারের এই দুই অংশ যদি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, তাহলে নির্বাচন কমিশন চাইলেও তা ঠেকাতে পারবে না। কমিশন যত আন্তরিকই হোক নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তাই সরকারের আন্তরিকতা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের এই আন্তরিকতা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার মাধ্যমেই প্রকাশিত হবে। তিনি বলেন, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন পৌরসভায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম গতকাল বলেন, আচরণবিধি বিষয়ে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোথাও লঙ্ঘন হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া বরগুনা-২ আসনের এমপির আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টা আমরা পত্রিকায় দেখেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর