শিরোনাম
রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আবাসন খাত

প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলেন ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবাসন শিল্প বাঁচাতে দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান এই খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বাসস্থান। এ জন্য আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে ৪০ লাখ আবাসন দরকার হবে। তাদের অভিযোগ, তারা প্রকল্প তৈরি এবং বিক্রি করতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও রোডের রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) কার‌্যালয়ে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের গৃহায়ণ শিল্পের বিদ্যমান সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে গৃহায়ণ শিল্প এবং লিংকেজ শিল্পসমূহ রক্ষা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব নিয়ে আলোচনা করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন। উদ্যোক্তারা জানান, প্রকল্প প্রস্তুত  করতে গিয়ে তারা যখন রাজউকের অনুমোদন চান, তখন রাজউক বলে পরিবেশ ছাড়পত্র লাগবে। আবার যখন পরিবেশ অধিদফতরে যান ছাড়পত্র আনতে তখন বলা হয়, রাজউকের অনুমোদন না হলে ছাড়পত্র মিলবে না। অপর দিকে ক্রেতারা ফ্ল্যাট কিনতে ভয়ে থাকেন যে, কখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ফ্ল্যাট ক্রয়ের অর্থের উৎস জানতে চায়। এতে আবাসন শিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।  মতবিনিময় সভায় আবাসন খাতের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন লিংকেজশিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা আরও বলেন, গৃহায়ণ শিল্প এবং এর সঙ্গে জড়িত লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজের নানাবিধ সমস্যা এবং সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ দরকার। বিশেষ করে আর্থিক ঋণ প্রবাহ না থাকায় আবাসন শিল্পে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আবাসন খাত সংকটে থাকায় সংকটে রয়েছে লিংকেজ শিল্প। ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস অর্থ সিঙ্গেল ডিজিট সুদে সরবরাহ করা গেলে আবাসন শিল্প এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পসমূহ সংকট থেকে রক্ষা পাবে। মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, আমাদের সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া বড় সমস্যাগুলো সমাধান হয় বলে আমার জানা নেই। আমরা আমাদের সমস্যাগুলো সম্মিলিতভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেব। এ জন্য কয়েকজন সংসদ সদস্য ও এফবিসিসিআইকে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে যাব। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককেও ডিও দেব। বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংকের অবস্থা শোচনীয়। প্রবাসীরা আবাসন খাতে বিনিয়োগের আস্থা পান না। জাতি হিসেবে আমাদেরকে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনিই একমাত্র সরকার প্রধান যিনি জাতিকে ২০২১ সালে মধ্যআয়ের উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন বিশ্বে শত চিন্তাবিদদের মধ্যে ১৩তম অবস্থানে আছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনিও আমাদের আবাসন শিল্প নিয়ে ভাবেন। তার কাছে আমাদের শিল্পের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পারলে, তিনি একটি ভালো সমাধান দিতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন বলেন, চারদিকে আইন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলে এ আইন ছাড়াবে কে? তাই আইনি জটিলতা এড়িয়ে আবাসন শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে ভ‚মি রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোরও দাবি করছি। বিএলডিএ-এর প্রতিনিধি ও বসুন্ধরা গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবুল কালাম শামিম বলেন, প্রবাসীরা ড্যাপে বিনিয়োগ করতে সাহস পায় না। এখানে রিং-রোড করার অর্থ হলো- বন্যার পানি মোকাবিলা করা। পরিবেশ রক্ষা করেই আমরা আবাসন করতে চাই। এক্ষেত্রে আমরা একটা বড় সমস্যার মধ্যে আছি। সেটা হলো- রাজউক বলে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র দিলেই তারা প্রকল্পের অনুমোদন দেবে। আবার পরিবেশ অধিদফতর বলছে, রাজউক অনুমোদন না দিলে তারা ছাড়পত্র দেবে না। এই জটিলতায় আবাসন খাতে লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে আছে। তিনি বলেন, ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি আছে। সঙ্গে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের ওপর ১ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এসব ফি কমানো দরকার। আবুল কালাম শামীম বলেন, ড্যাপ আতঙ্কের কারণে আবাসন শিল্পে অনেকেই বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এখন আবার ড্যাপ সংশোধন করে কনজারভেটিভ এরিয়া দেখানো হচ্ছে। এই কনজারভেটিভ এরিয়া দিয়ে নতুন ‘ষড়যন্ত্র’ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থার কারণে আবাসন খাতে জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের সরকার এখন ভ্যাটের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা স্টিলে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের দাবি ইতিমধ্যে করেছি। জানি না এনবিআর নতুন ভ্যাট আইনে আমাদের জন্য কী করবে। এনবিআর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করলে রি-রোলিং শিল্প বড় ধরনের আন্দোলনে যাবে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সচিব জুলফিকার আলী বলেন, আমরা মূলত সরকারি প্রকল্পে কাজ করি। এক্ষেত্রে আমার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট ক্যালকুলেটর নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছি। কারণ এনবিআর নিজেই তাদের ভ্যাট ক্যালকুলেটর মানছে না। বড় প্রকল্পগুলোতে বিদেশি জনবল নিয়োগও একটি বড় সমস্যা বলে মনে করি।

বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. আবু বকর ইট পোড়ানো আইন বড় বাধা দাবি করে বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা কিন্তু ফসলি জমিতে ইট ভাটা চাই না। এক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সবুজ অর্থনীতি প্রকল্পের ৪০০ কোটি টাকা তহবিল থেকে পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ইট প্রস্তুতকারকরা ঋণ পায়নি। বাংলাদেশ পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবদুল আহাদ বলেন, পাথর ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ নেই। দীর্ঘ দিন ধরে দেশে কোনো পাথর উত্তোলন নীতি ছিল না। তবে দুই বছর আগে পাথর উত্তোলন নীতিমালা তৈরি করা হয়। তাতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব বা অংশগ্রহণ রাখা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছামতো পাথর উত্তোলন নীতিমালা করা হয়েছে। ফলে এ বছর পাথর উত্তোলন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে পাথর সংকট রয়েছে। এই সংকট উত্তরণে পাথর আমদানিও করা হয়। কিন্তু বর্তমানে আমদানির এলসি বা ঋণপত্র বন্ধ থাকায় দেশে পাথর সংকট চলছে। ভুটান থেকে পাথর আমদানিতে খরচ পড়ছে বেশি। এই সংকট উত্তরণে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তিনি। বাংলাদেশ পেইন্টস ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, দেশে রঙের চাহিদা পূরণে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে রঙের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কর আছে। এটা থাকা উচিত নয়। সম্পূরক শুল্ক কর কমলে রঙের দাম কমবে। বর্তমানে আবাসন খাতের অস্থিরতার কারণে রঙের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবাসন খাতে গতিশীল হলে রং উৎপাদন খাতেও গতিশীলতা আসবে। মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন রিহ্যাবের প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া, সহসভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান, প্রকৌশলী সরদার মো. আমিনসহ বিভিন্ন লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা।

সর্বশেষ খবর