বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের পালাতে দেওয়া হবে না

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের পালাতে দেওয়া হবে না

১৯৭১-এর ডিসেম্বরে শুরু হয় বাংলাদেশের মাস। ’৭১-এর যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর আত্নসমর্পণের মধ্য দিয়েই এশিয়ায় মুক্তসূর্য উদিত হয়। তার আগের ঘটনা, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৮ তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচালন কমিটির চার নেতা- অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং যুদ্ধ পরিচালনা মন্ত্রী আবু হেনা কামারুজ্জামান যশোর স্টেডিয়ামে স্বাধীন বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব শুরু করেন। সেখানে তারা ঘোষণা করেন, হানাদার পাকিস্তানি সেনারা পালাচ্ছে। ওদের পালাতে দেওয়া হবে না। দুই দিন আগেই ৬ ডিসেম্বর এই সেক্টরে কার্যত যুদ্ধ থেমে যায়। পাকিস্তান বাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে এদিক-ওদিক নানা গঞ্জে ঢুকে পড়ে। যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান ও রাজাকারদের কার্যকলাপ বন্ধ করতে বাধ্য করে ভারতীয় বাহিনী। সেই স্বাধীনতা উৎসবের আমি রিপোর্টও করেছি। তার একদিন আগে ভারতের প্রতিরক্ষার প্রচার দফতর থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল, ৮ ডিসেম্বর যশোরে যেতে হবে। আমরা যেন প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত থাকি। শুধু আমরাই নয়, সেদিন ছিল কয়েকশ বিদেশি রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যানও। যশোর যেতে পারব কিনা ঠিক ছিল না। হঠাৎ এই আমন্ত্রণে আমরাও একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। যশোর যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী দ্রুত খাল-বিলের ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল। একটু এগোতেই দেখি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজছে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে তৈরি করা গানও বাজছিল।  স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় ঢেকে সাজানো হয়েছিল মঞ্চটি। স্বাধীন বাংলাদেশে আসতে পেরে সেদিন আমরাও সমান রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। এরপর শুরু হলো অনুষ্ঠান। মঞ্চে ওই চার নেতা ছাড়াও ছিলেন বিএমএফের পদস্থ কর্তারা। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক সৈনিক ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানসহ আরও অনেকে, যাদের সবার নাম এখন মনে নেই। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করেছি।

এখন আমরা স্বাধীন। জয় বাংলা। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, আপনাদের স্বপ্ন সফল হয়েছে। আপনারা এবার দেশ গঠন করুন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করুন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বলেন, আপনারা মনে রাখবেন, যে কোনো মুহূর্তে ঢাকা থেকে খান সেনাদের আমরা হটিয়ে দেব। আপনারা প্রস্তুত থাকুন। কামারুজ্জামান যশোর-খুলনা সেক্টরের মানুষকে বলেন, খান সেনারা ভৈরব নদীর জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। ওদের পালাতে দেওয়া হবে না। সেদিন যশোরের মানুষ ডিসেম্বরের শীতে কার্যত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে স্বাধীনতা উদযাপন করেছিলেন। কলকাতার এক প্রবীণ সাংবাদিক যার বাড়িও ছিল যশোরে মাইক হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের দেশ স্বাধীন করতে সাহায্য করল কে? উদ্বেলিত জনতা সেদিন বলেছিল, ‘জওহর লালের মাইয়া ইন্দিরা’। সেই সঙ্গে আকাশবাণীর কথাও বললেন তারা। আর আনন্দবাজার পত্রিকা। কিছুক্ষণের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ ওই এলাকাতে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠলেন। কেউ পটকা ফোটাচ্ছেন, কেউ মশাল জ্বালাচ্ছেন। সেই প্রবীণ সাংবাদিক, যুগান্তর পত্রিকার অনিল ভট্টাচার্য গ্রামবাসীদের বললেন, যশোরের পাটালি খাওয়াও। ওরা বললেন, যুদ্ধের জন্য গাছ কাটা হয়নি। আপনাদের ঠিকানা দিয়ে যান, আমরা পাঠিয়ে দেব। এরপর ওই চার নেতা কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কলকাতার দিকে রওনা দিলেন। আমরা যশোর টাউনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। চারপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে জয় বাংলা। ঢাকার আগে যশোরের পতনটাও খুব অদ্ভুত। ভারতীয় বাহিনীর কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছিল নিয়াজি বাহিনী। ভারতীয় সেনারা ফোর্ট উইলিয়ামে খবর পেয়েছিলেন পাক সেনারা বনগাঁ দখল করার জন্য পাঁচটি ট্যাঙ্ক পাঠিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ঠিক করে মাঝপথে তাদের বাধা দেওয়া হবে না। বনগাঁয় ঢোকামাত্রই ওই পাঁচটি ট্যাঙ্ক ঘিরে ফেলে ভারতীয় বাহিনী। আর তার পরদিনই যশোর-খুলনা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় বাহিনী। এরপর বরিশাল, ফরিদপুরসহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের নিয়ন্ত্রণ নেয় ভারতীয় বাহিনী এবং যৌথবাহিনী।

সর্বশেষ খবর