সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

এক মাটির গাছ আরেক মাটিতে ভালো হয় না

সমরেশ মজুমদার

এক মাটির গাছ আরেক মাটিতে ভালো হয় না

দিনপনেরো আগে আমার ল্যান্ডলাইনে একজন ফোন করলেন। মহিলার গলা। যখন বুঝলেন তিনি ঠিক লোকের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন হেসে নিজের নাম বললেন। এই বয়স পর্যন্ত আমি যেসব মানুষকে চিনি বা যাদের কথা শুনেছি তাদের অনেকের নাম এক, পদবি আলাদা হতেই পারে। এই নামটি শোনামাত্র আমার মনে যাদের কথা এলো তাদের আমি গত ২০ বছরের মধ্যে দেখেছি। পরিষ্কার করার জন্য তিনি তার বিয়ের আগের পদবি বলতেই এক নিমিষে সব কুয়াশা কেটে গেল। আমার দেখা তিনজন সেরা সুন্দরীর কথা বলতে হলে যার নাম প্রথমে বলতে হবে ইনি সেই মহিলা। আমি তখন জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের শেষ ধাপের ছাত্র। সদ্য গোঁফ বেরিয়েছে, গালে দাড়ি জানান দিচ্ছে। ওই সময় শেষের কবিতা থেকে দেবদাস পড়ে ফেলেছি। কিনু গোয়ালার গলি কবিতাটি মুখস্থ বলতে পারি। সেটা এমন একটা বয়স যখন সৌন্দর্যকে গিলতে ইচ্ছা করে। এই মহিলা, যিনি তখন অপরূপা এবং অবিবাহিতা। তাকে দেখে মনে হতো, আহা কী সুন্দরী! তদ্দিনে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি পড়ে ফেলেছি কিন্তু কবির সঙ্গে একমত হতে পারিনি এই একটি ক্ষেত্রে। কবি লিখেছিলেন, গোলাপের দিকে চোখ মেলে বললুম, সুন্দর, সুন্দর হলো সে। পরবর্তী জীবনে আমার চেতনার রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি যাকে যেমন চেয়েছি, কিন্তু এই মহিলা, আমি কিছু ভাবার অনেক আগেই সুন্দরী হয়েছিলেন। বোধহয় সৃষ্টি শেষ করে ঈশ্বরও নিজের শিল্পকর্ম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই মহিলা অবশ্যই আমার অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন। অতএব তিনি হয়তো ভ্রাতৃস্নেহে আমাকে দেখেছেন। কিন্তু তাকে আমরা আমাদের মানুষ বলেই ভাবতাম, ভেবে গর্ববোধ করতাম। এই মহিলা হেসে বললেন, ‘চেনা যাচ্ছে! প্রায় ৫৫ বা ৫৭ বছর আগের কথা। চিনতে না পারাই তো স্বাভাবিক।’ বললাম, ‘খুব ভালো লাগছে ফোনটা পেয়ে।’ তিনি বললেন, ‘তোমাকে ফোন করছি কেন, জান? কলকাতায় একটা সম্মেলন হচ্ছে। জলপাইগুড়িতে যারা ছিলেন, যাদের সঙ্গে জলপাইগুড়ির এখনো যোগাযোগ আছে অথবা নেই, তাদের অনেকে এই সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন। আমাদের ইচ্ছা তুমিও সম্মেলনে এসো।’ উনি আমাকে তুমি বললেন। এটাই তো স্বাভাবিক। বললাম, ‘আচ্ছা, আমার এই ল্যান্ডলাইনের নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন?’ ‘এই তো, একটু আগে পেলাম।’ মহিলা যার কাছ থেকে আমার নাম্বার পেয়েছেন বললেন, তার নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি ৫৮-৬০ এর জলপাইগুড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম বলেই ওকে চিনতে পারলাম। আমাদের সেই সময়ে জলপাইগুড়িতে যারা সুন্দরী এবং স্মার্ট তরুণী হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন ইনি তাদের একজন। বললাম, যদি সুস্থ থাকি তাহলে সম্মেলনে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। রিসিভার নামিয়ে মনে হলো, যে ভদ্রমহিলা আমার ফোনের নাম্বার দিয়েছেন তাকে তরুণ বয়সে কয়েকবার দেখেছি কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়নি। যদি হতো কী কথাই বা বলতাম! কিন্তু সেই মহিলা এত বছর পরে আমার টেলিফোন নাম্বার দিতে পারলেন কী করে! চার বছর বয়সে আমি আমার পিতামহ এবং বড় পিসিমার সঙ্গে চা বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরে এসেছিলাম ভালো স্কুলে ভর্তি হবো বলে। ভুল বললাম, আমি আসতে চাইনি, আমাকে জোর করে পাঠিয়েছিলেন বাবা। পিতামহ সমর্থন করেছিলেন। আসার দিন সকালে খুব কেঁদেছিলাম। বাড়ির পেছনে বাগান, ওপাশের আংরাভাসা নদী দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল ওরা এদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাত্ কী মনে হয়েছিল, একটা কাপড়ের টুকরোর মধ্যে দু’মুঠো মাটি বেঁধে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জলপাইগুড়ির বাড়িতে মাটিটাকে রেখে রোজ দেখব আর মনে হবে আমি চা বাগানের বাড়িতেই আছি। জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসে দেখলাম বাগানে অনেক অচেনা গাছ। তাদের একপাশে মাটিটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু দুদিন পর অবাক হয়ে দেখলাম, মাটিটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমায় কাঁদতে দেখে বড় পিসিমা এসে সব শুনে বললেন, ‘বোকা ছেলে, কাঁদছিস কেন? তোর নিয়ে আসা মাটি এখন সব বাগানে ছড়িয়ে গেছে।’ শুনে একটু শান্ত হলাম। আর তাই যখনই ছুটিতে চা বাগানে গেছি তখনই একটা না একটা গাছের চারা নিয়ে এসে জলপাইগুড়ির বাগানে মাটিতে পুঁতে নিয়মিত জল দিয়েছি। দেখতে দেখতে গাছগুলো যখন দাঁড়িয়ে গেল তখন মনে হলো, চা বাগানের বাড়ির বাগানটাকেই যেন দেখতে পাচ্ছি। মন ভালো হয়ে গেল। তখন মন কেমন করা অনুভূতিগুলো ক্রমশ নেতিয়ে গেল। কিন্তু ধাক্কা খেলাম বেশ কয়েক বছর পরে। আমার লাগানো লিচু গাছ তখন বড় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাতে লিচু ধরল। আমার কী আনন্দ। যখন সেই লিচু বড় হলো তখন গাছ থেকে পেড়ে দেখলাম তার শাঁস শুকনো, ফলগুলোয় পোকা ধরেছে। অথচ ওর আত্মীয় গাছগুলোতে চা বাগানের বাড়িতে দিব্যি পুরুষ্ট এবং রসালো লিচু ফলছে। বড় পিসিমা বললেন, ‘এরকম হয়। এক মাটির গাছ আর এক মাটিতে ভালো হয় না।’ খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। দার্জিলিংয়ের কমলালেবুর গাছ জলপাইগুড়িতে লাগালে হতাশ হতে হয়। তাই বলে লিচুও? যখন কলকাতায় পড়তে এলাম, তখন বয়স ১৭। মফস্বল শহরের যেসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে বড় হয়েছি তা যে কলকাতায় অচল তা বুঝতে বেশ কয়েক মাস সময় গিয়েছিল। এই শহর যেমন দেয় তেমন নেয়ও। এই টানাপড়েনের মধ্যে যে সচল থাকতে পারে ভাগ্য তার অনুকূলে। এই শহরে কাপড়ে বেঁধে আনা মুঠোর মাটির কোনো দাম নেই। রাতে হঠাত্ মনে হলো, কবি যতই লিখুন ‘আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে— কিছুই কি নেই বাকি? রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’— থাকতেই পারে। বিজ্ঞানও তাই বলে। কিন্তু সেই ১৬-১৭-১৮ বছরের মুখগুলো যা মনে গাঁথা আছে, তা সত্তর পেরিয়ে এক অবস্থায় থাকতে পারে না। পরিবর্তন হতে বাধ্য। যেমন সেই লিচু গাছটার হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর