বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়া কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কে

৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তারেক রহমান একই বিতর্ক তুলেছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে হঠাৎ করেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এক মন্তব্যে সব মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মিণীর এ ধরনের মন্তব্যে রাজনৈতিক মহল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধির মধ্যে ক্ষুব্ধ মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। আসন্ন পৌর নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বেগম জিয়া কেন আবার ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখলেন—এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ ধরনের বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহারের পাশাপাশি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজকে বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানারকম তথ্য আছে।’

এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ লন্ডনে স্থানীয় এক হোটেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বললেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।’ বিগত পাঁচ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি জোটের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনো লন্ডনে এমন ধারায় ইতিহাস চর্চা করছিলেন তারেক রহমান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকবন্ধু’ ও ‘খুনি’ বলে আখ্যা দেন তিনি। ওই সময় এ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা মহলে তুমুল বিরূপ বিতর্ক হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মানহানি মামলাও দায়ের করা হয়।

এ প্রসঙ্গে দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, ‘খালেদা জিয়া যে কথা বলেছেন, তা নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার কোনো রুচি আমার নেই। তার এ ধরনের বক্তব্যের আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন? খুবই দুর্ভাগ্যজনক, খুবই ন্যক্কারজনক।’  রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট হায়দার আকবর খান রনোর মতে, ‘খালেদা জিয়া হয়তো জামায়াতকে খুশি করার জন্যই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এ সংখ্যা কিছু কমবেশি হলেও প্রতীকী অর্থে ৩০ লাখ শহীদের কথাই স্বীকৃত। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য দিয়েছেন। অবিলম্বে তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কমাতে গিয়ে উনি (খালেদা জিয়া) কী বোঝাতে চেয়েছেন, তাও বোধগম্য নয়।’ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে বিএনপি যে মুক্তিযুদ্ধের দল নয়, তা আবারো প্রমাণ করল। এতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও খাটো করা হয়েছে। এটা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে কেউ যদি গবেষণা করেন, তা আলাদা বিষয়।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পর মীমাংসিত একটি বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। জানি না, কেন তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিলেন। মীমাংসিত একটি বিষয়ে যতই এ ধরনের বিতর্ক হবে, সমস্যা ততই বাড়বে। এতে নতুন প্রজন্ম আরও বিভ্রান্ত হবে। তার মতো একজন নেত্রীর শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হয়নি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ভাষায়, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। তবে একজন গবেষক যদি এই সংখ্যার কমবেশি নিয়ে গবেষণা করেন, তাও মানা যায়। কিন্তু ওনার মতো একজন রাজনৈতিক দলের প্রধান যখন এ ধরনের প্রশ্ন  তোলেন, তখন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের সরকার থেকে যখন কটাক্ষ করে কথা বলা হয়, ঠিক এ মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসনের এ ধরনের বক্তব্য খুবই দুঃখজনক। যারা উপদেশ দেন, তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’

খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাইতে হবে : মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বিজয়ের মাসে ‘পাকিস্তানপ্রেমী বক্তব্যের’ জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনকে ক্ষমাও চাইতে বলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা সংগঠনটি। গতকাল নির্মূল কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা খালেদা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমী বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করছি। এ ধরনের বক্তব্যের জন্য  দেশ ও জাতির নিকট বিএনপির ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করছি।’ সংগঠনটির বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘যখন পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমালোচনা করে একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার করছে, ঠিক তখন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সরকারি ও স্বীকৃত পরিসংখ্যান অস্বীকার করে আবারও প্রমাণ করেছেন একাত্তরে তিনি যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনুগত ছিলেন, এখনো সেই অবস্থানে অটল রয়েছেন।’ নির্মূল কমিটি বলছে, যে কোনো দেশে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা সে দেশের সরকারের দাবি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি হত্যায় নিহতের পরিসংখ্যানের উদাহরণও তুলে ধরেছে তারা।

সর্বশেষ খবর