রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঘটনাস্থল সেই বাগমারা

এবার মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা, সন্দেহভাজন হামলাকারী নিহত, আহত তিন

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

ঘটনাস্থল সেই বাগমারা

মসজিদ থেকে সন্দেহভাজন আত্মঘাতী যুবকের ক্ষত বিক্ষত মরদেহ বের করা হয় (বাঁয়ে), হাসপাতালে আহত শিশুসহ দুজন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের উত্থান ও পতনের এক যুগ পর আবারও আলোচনায় বাগমারা। এবার মসজিদে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন বোমা বহনকারী যুবক। শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এতে আহত হয়েছেন আরও তিনজন।

বোমার স্প্লিন্টারে আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন সাহেব আলী তালুকদার, ময়েজ উদ্দন ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র নয়ন। তবে পুলিশ গতকাল পর্যন্ত নিহত যুবকের পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি। গতকাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত বোমা বহনকারীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করেছে র‌্যাব। বাগমারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মতিয়ার রহমান জানান, উপজেলার সৈয়দপুর চকপাড়ার ওই মসজিদটিতে জুমার নামাজ চলাকালে দ্বিতীয় রাকাতের রুকুর সময় বোমা হামলাকারী বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। স্থানীয়ভাবে মসজিদটি কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের বলে পরিচিত।

হামলার বর্ণনা দিলেন আহতরা : বাগমারায় কাদিয়ানি জামে মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বোমা হামলাকারী নিহত হলেও বেঁচে গেছেন তিনজন। যাদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়েই নামাজ পড়ছিলেন হামলাকারী যুবকটি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা সংবাদকর্মীদের কাছে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। সৈয়দপুর গ্রামের স্কুলছাত্র নয়ন জানায়, মসজিদে কোরআন শিক্ষার তালিম চলছিল কয়েক দিন থেকে। তার বয়সের গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে সেও কয়েক দিন থেকে মসজিদে ছিল। শুক্রবার আজানের পর নামাজের প্রস্তুতি শুরু হয়। ওজু করে পেছনের সারিতে নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়ায় সে। প্রথম রাকাত নামাজ শেষ হওয়ার পরে দ্বিতীয় রাকাতের রুকুতে যাওয়ার পরপর বিকট শব্দ তার কানে আসে। ডান কোমরে আঘাত অনুভব করে সে। নামাজ থেকে ছিটকে অল্প দূরে পড়ে যায়। এরপর সে আর কিছুই বলতে পারে না। আহত আরেকজন হচ্ছেন ওই গ্রামের সাহেব আলী তালুকদার। তিনি জানান, মসজিদে ওই যুবককে তিনি অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে যুবকটি সুন্নাত নামাজ পড়ছিলেন। নামাজের ফাঁকে তাকে সামনের সারিতে যাওয়ার জন্য বলেন তিনি। সাহেব আলী আরও জানান, হামলাকারী ওই যুবক সুন্নাত নামাজ পড়ার সময় পেছনে থাকলেও ফরজ নামাজ শুরুর সময় সামনের সারিতে তার ডান পাশে এসে দাঁড়ান। যুবকটি একেবারেই স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। রুকুতে যাওয়ার পরই বিকট শব্দ। এরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। আহত ময়েজ উদ্দন জানান, মসজিদে মোট দুই কাতারে নামাজ হচ্ছিল। তিনি দ্বিতীয় কাতারে ছিলেন।

হাটবার কাজে লাগিয়েছেন হামলাকারী : হাটবারের সুযোগ নিয়ে হামলাকারী বাগমারার কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের মসজিদে হামলা চালিয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। কারণ শুক্রবার মচমইল বাজারে বসে পানের হাট। স্থানীয়রা জানান, মচমইল বাজারে সপ্তাহে চার দিন হাট বসে। এর মধ্যে শুক্র ও সোমবার পান ও বাঁশের হাট বসে। রবিবার বসে গরুর হাট আর বুধবার সাধারণ হাট। হাটের দিনে ওই মসজিদে বাইরের অনেক মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন। গ্রামে পাশাপাশি তিনটি মসজিদ আছে। একটি কাদিয়ানি, একটি হানাফি ও অন্যটি আহলে হাদিস পন্থিদের। কাদিয়ানি মসজিদটি ছিল মাঝখানে। মুসল্লিরা জানান, জুমার আজানের পরপরই দুজন অপরিচিত ছেলে মসজিদে প্রবেশ করেন। অনেকেই তাদের পান বিক্রেতাও মনে করেন। অপরিচিত হিসেবে কয়েকবার কথাও হয় তাদের সঙ্গে। হাটবার ছাড়া পরিচিতরাই ওই মসজিদে নামাজ পড়ে থাকেন। যারা ওই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি তাদের সবাই সবার চেনা। কিন্তু ওই দুই যুবক পরিচিত ছিলেন না।

হামলাকারী তিনজন : প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী হামলাকারী ছিলেন তিনজন। এদের একজন নামাজ চলাকালে বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন ও অন্য দুজন মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যান। মুসল্লিদের কয়েকজন জানান, বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটার পর সবাই নিহত যুবকটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সুযোগে মোটরসাইকেল নিয়ে অন্য দুই যুবক সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী এ ঘটনার সঙ্গে তিনজনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে ঘটনার পরিকল্পনাকারীদেরও চিহ্নিত করতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে।

আগেই সতর্ক করেছিলেন গোয়েন্দারা : হামলার আশঙ্কায় গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল রাজশাহী আহমদিয়া (কাদিয়ানি) জামাতের মসজিদসংশ্লিষ্টদের। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, মচমইলের সেই মসজিদে বিস্ফোরিত তিনটিই স্থানীয়ভাবে ইমপ্রোভাইসড ডিভাইস দিয়ে তৈরি সকেট বোমা।

অজ্ঞাতদের নামে মামলা : কাদিয়ানি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দায়েরকৃত মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে বাগমারা থানা পুলিশ মামলাটি দায়ের করে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাগমারা থানার ওসি মতিয়ার রহমান জানান, অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে মামলায়। তবে এ হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এমনকি হামলাকারীর পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তারা তদন্ত শুরু করেছেন।

হামলাকারীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন : গতকাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত বোমা বহনকারীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. এনামুল হক জানান, নিহত যুবকের বয়স ২০-২২ বছর। বোমাটি তিনিই বহন করছিলেন। বিস্ফোরণের ফলে নিহত একজন মানুষের শরীরে যে ধরনের আলামত থাকে তার সবই পাওয়া গেছে ওই যুবকের শরীর থেকে। নিহত যুবকের পেটের ভিতরে চারটি স্প্লিন্টার পাওয়া গেছে। সেগুলো পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। বোমাটি নাভির লেভেলে ছিল।

দুজন আটক : মসজিদে বোমা হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করেছে র‌্যাব। গতকাল সকালে রাজশাহী র‌্যাব সদস্যরা তাদের আটক করেন। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আটক ব্যক্তিদের পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।

আত্মঘাতী হামলা কিনা, রহস্যে পুলিশ : কাদিয়ানি মসজিদে বোমার বিস্ফোরণ ঘটলেও তা আত্মঘাতী ছিল কিনা এ নিয়ে রহস্যে পড়েছে পুলিশ। হামলাকারীর শরীর তারে পেঁচানো ছিল। এ থেকে নিহত যুবককে আত্মঘাতী বলা হলেও পুলিশ এখনই তা নিশ্চিত করছে না। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, তারা এখন নিহত যুবকের পরিচয় উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে বাকি বিষয় পরিষ্কার হওয়া যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর