রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সব পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সব পক্ষকেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। জনগণকে ভয়ভীতিহীনভাবে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। নির্বিঘ্নে ভোটদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের। তাদের এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওয়াচডগ হিসেবে গণমাধ্যম ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদেরও যথাযথ দায়িত্ব পালন করা জরুরি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত গতকাল সকালে এক গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাচন বিশ্লেষকরা এ অভিমত দেন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড (ইডব্লিউএমজিএল) কনফারেন্স রুমে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন রাজনীতিবিদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম।   গোলটেবিল অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার ছিল ৭১ টিভি। অনুষ্ঠানটি ৭১ টিভি সরাসরি সম্প্রচার করে। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ (অব.), সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রুহুল আমিন হাওলাদার, সাবেক মন্ত্রী কর্নেল জাফর ইমাম বীরবিক্রম (অব.), নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মো. আবদুর রশীদ (অব.), সাবেক সংসদ সদস্য মেজর আখতারুজ্জামান (অব.), সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ হাদিস উদ্দিন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও ফেমার  প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, ৭১ টেলিভিশনের পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহসান হাবীব। আলোচনায় আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিকমতো হচ্ছে না। বিএনপির পক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপিরা অংশ নিচ্ছেন। আমাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে কিনা সেটাই প্রশ্ন? নির্বাচন কমিশন যে বিধিনিষেধ করেছেন সেটা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘এমপি হিসেবে প্রচারণায় অংশ নেওয়া আমার সাংবিধানিক অধিকার। যেহেতু এমপিরা কোনো সুবিধা ভোগ করেন না। সরকারি দলের প্রতি অনেকটা অবিচার করা হয়েছে। বিএনপি সংসদে নেই, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।’ বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘গণমাধ্যমে এসেছে এসব আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাহাড় জমেছে নির্বাচন কমিশনে। প্রধান নির্বাচন কশিনার (সিইসি) কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সরকারপ্রধানের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইসির ঘাড়ে কয়টি মাথা আছে যে, তারা মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। সিইসিকে ধন্যবাদ যে, উনি মেনে নিয়েছেন যে মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। এখনো সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিটি পৌরসভায় প্রভাব বিস্তার করছেন। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সরকারের পক্ষে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়।’ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, ‘তাদের যে আইনি শক্তি আছে, তা দৃশ্যমান করার সময় এখনো আছে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকবে না, দলীয়ভাবেই থাকবে। কিন্তু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য দলগুলোকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। যদি আচরণবিধি দলের কেউ না মানেন, তাহলে দলই যেন তাকে সতর্ক করে দেয়। আর কোনো মন্ত্রী যদি না মানেন, তাহলে দলপ্রধান যেন সেটা দেখেন। আর নির্বাচন কমিশনকেও সেটা দেখতে হবে। এ কাজে দলের যিনি প্রধান, তাকেও নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে।’ জাতীয় পার্টির নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে নানা সংশয় সৃষ্টি হয়। একে অন্যে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছুড়ে মারেন। নানা অঘটনও ঘটে। আবার সরকারে থাকলে অনেক কথা শুনতে হয়, বিরোধী দলে থাকলে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা থাকা দরকার। আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, বিরোধী দলেও ছিল। আমরা মনে করি, পৌর নির্বাচন সেই পরিবেশ তৈরি করবে। তবে আমাদের (রাজনৈতিক দলগুলোকে) সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে।’ বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের লড়াইয়ের মাধ্যমে নির্বাচনে জাতীয় আমেজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ধরনের লড়াই নিয়ে জনগণের আগ্রহ অনেক। তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে চায়। এ জন্য নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। আগেও নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে, টাকা ছড়ানো হয়েছে। দেশে নির্বাচনে এগুলো নতুন নয়।’ ‘আমরা চাই, নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন ও সব অভিযোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে নিজেদের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে যথাযথভাবে কাজ করবে।’ কর্নেল জাফর ইমাম বীরবিক্রম (অব.) বলেন, ‘গ্রামে সংখ্যালঘুদের  ভোট কেন্দ্রে আসতে দিতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমি মনে করি, এ নির্বাচনটি কমিশনের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ। এবং এ চ্যালেঞ্জটা যেন আগামীতে ঠিক থাকে। জাল ভোট হলে ওই কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। নচেৎ এসব বিষয় ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এখন যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাচ্ছে।’ মেজর জেনারেল মো. আবদুর রশীদ (অব.) বলেন, ‘আমরা চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচনে বরাবরই কিছু সহিংসতা-সংঘর্ষ হয়। সহিংসতা শতভাগ বন্ধ হয়ে যাবে, সেটাও বলা যাবে না। এটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। অনেকেই দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।’

মেজর আখতারুজ্জামান (অব.) বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভেবেছিল তারা এ নির্বাচনে সুবিধা নেবে। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে এখন বেকায়দায়। বিএনপি একক প্রার্থী দেওয়ায় অনেক সুবিধায় রয়েছে। রাজনীতি এখন দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। ২৩৪-এর মধ্যে অন্তত ২০০টিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আমেরিকায়ও দুটি দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।’ সাবেক আইজিপি হাদিস উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনের অস্থিরতা যেটুকু আছে তা আমাদের কন্ট্রোলের ভিতরেই। পৌরসভার এ নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করছে। আশা করা যাচ্ছে, তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয়  দেবে। সে ক্ষেত্রে আশা করা যায় নির্বাচনী সংঘর্ষ অনেকাংশেই কমে আসবে। একটি নির্বাচনী পরিবেশ দেখা যাবে।’

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়ে যাবে। তবে শান্তিপূর্ণভাবে হলেও কারচুপি হতে পারে। কিন্তু আদৌ পৌরসভার কোনো উন্নয়ন হবে। পৌরসভা নিয়ে দুই দলের তো কোনো পলিসিই নেই। দলীয় নির্বাচন করা ঠিক আছে।’

ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেন, ‘আমরা হচ্ছি ওয়াচডগ। নির্বাচনের কতগুলো পক্ষ থাকে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, ভোটার ও আমরা (পর্যবেক্ষকরা) তাদের একটি অংশ। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে, সরকার যেমন কমিটমেন্ট দিয়ে নির্বাচনকে ভালো করতে চায়। আমরাও তেমনি ওয়াচডগ হিসেবে কোথায় ভুলত্রুটি হলো তা দেখিয়ে দেব সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে।’ ব্রতীর শারমীন মুরশিদ বলেন, নির্বাচন এমন একটি ইভেন্ট যাকে  কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এমন  কোনো নির্বাচন হয়নি যেখানে কম-বেশি সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি।’ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় নির্বাচন বেশি চ্যালেঞ্জিং। এবার দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে। সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মিডিয়ারও দায়িত্ব নেগেটিভ সংবাদ অপেক্ষা বেশি বেশি পজিটিভ খবর প্রচার করা।’ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, বিএনপি এমন এক সরকারের অধীনে অংশগ্রহণ করছে এর আগে তারা এ সরকারকে মেনে নিতে চায়নি।’ জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘বলা হয় বাংলাদেশে জনগণ ভোট দেয়। আসলে তা নয়, ভোট নিয়ে নেওয়া হয়। এখানে ইচ্ছামতো ভোট দেওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি।’ ব্যারিস্টার আহসান হাবীব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এর কিছু সংস্কারের প্রয়োজন আছে।’

সর্বশেষ খবর