রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জঙ্গি হামলা থামছে না কেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

জঙ্গি হামলা থামছে না কেন

দেশের বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব  হামলার ধরন একই। একই কায়দায় ও একই রকম অস্ত্র, বিস্ফোরক ব্যবহার করা হযেছে। কেন থামছে না এ ধরনের হামলা? জঙ্গিবাদ ঠেকাতে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, যেহেতু ধর্মের নাম ব্যবহার করে এই অপতত্পরতা চালানো হচ্ছে, সেজন্য আলেম-ওলামা বা ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সারা দেশে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। গ্রামগঞ্জসহ সব মসজিদের খুতবায় জঙ্গি তত্পরতার বিরুদ্ধে আলেম-ওলামাদের বক্তব্য দিতে হবে। কারণ তাদের কথা মানুষ শোনে। সেই সঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে বলে বিশিষ্টজনরা অভিমত ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০০৪-০৫ সালের দিকে বাংলা ভাইদের উত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের প্রকট উত্থান হয়েছিল। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীগুলো অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্য তখন কোনো বিচার-বহির্ভূত প্রক্রিয়ারও প্রয়োজন হয়নি। সাধারণ আইনের মাধ্যমেই পরিস্থিতি উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। এখনো সেভাবেই সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ তিনি বলেন, জঙ্গি কার্যক্রম বন্ধের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা তৈরি। যেহেতু ধর্মের নামে এ ধরনের অপতত্পরতা চালানো হচ্ছে, সেহেতু সচেতনতা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে ধর্মীয় নেতাদের। তারাই বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে পারে। জঙ্গি দমনের বিষয়ে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী জঙ্গি দমনে বেশ ভূমিকা রাখছে। তবে তাদের গোয়েন্দা তত্পরতা আরও বাড়াতে হবে। আগাম গোযেন্দা তথ্য থাকলে জঙ্গি দমন করা আরও সহজ হবে। একই সঙ্গে দমনের জন্য আন্তঃবাহিনীর মধ্যে এ বিষয়ে সমন্বয় রাখতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে কাউন্টার টেরোরিজম সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিল। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি মাথায় রেখে ওই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। বিশেষ আইন প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গি দমনের বিষয়ে ‘এন্টি টেরোরিস্ট অ্যাক্ট-২০০১’-এ সবকিছুই আমলে নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। খুটিনাটি সবকিছুই আইনে উল্লেখ রয়েছে। প্রয়োজনে আমাদের দেশে এ ধরনের আইনও প্রণয়ন করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ‘যেভাবে জঙ্গি তত্পরতা বাড়ছে তাতে আশঙ্কার বিষয়। এ নিয়ে সরকারকে আরও সজাগ থাকতে হবে। গোয়েন্দা তত্পরতা বাড়াতে হবে। গ্রামগঞ্জসহ সব মসজিদে খুতবায় জঙ্গি তত্রপতার বিরুদ্ধে আলেম-ওলামাদের বক্তব্য দিতে হবে। তাদের কথা মানুষ শোনে।’  তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে গণতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে বিকাশ পাচ্ছে না, সেখানেই জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে। আমাদের দেশেও গণতন্ত্র পুরোপুরিভাবে বিকশিত হচ্ছে না। এটাও বড় অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বাক-স্বাধীনতাও প্রকাশের সুযোগ দেওয়া জরুরি।’  মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, দেশে জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি হামলা স্বতন্ত্র উদ্দেশে নিয়ে চালানো হচ্ছে। ধারণা করছি জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের বৃহত্তর স্বার্থ বা লক্ষ্য পূরণের জন্য এ হামলাগুলো করছে। সর্বশেষ বাগমারা মসজিদে হামলার ঘটনায় জঙ্গি হামলার নতুন প্যাটার্ন পাওয়া গেছে। মুসলমানদের মধ্যেই এক ধরনের উগ্রগোষ্ঠী আছে যারা আহমদিয়া ও শিয়া সম্প্রদায়কে মুসলমান মনে করেন না। আবার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যাজকদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। হিন্দুদের ওপর ও তাদের মন্দিরে হামলা হচ্ছে। আমি মনে করি, এসবের সঙ্গে বিদেশি হত্যাকাণ্ডেরও যোগসূত্র আছে। ধারণা করছি, যেসব জায়গায় সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সন্দেহ কম সে জায়গাগুলোতে হামলা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলোতে এ হামলাগুলো দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি হচ্ছে। কারণ সেখানে জামায়াতের প্রভাব ও সমর্থক গোষ্ঠী বেশি। এ ছাড়া এখানে দরিদ্রতা বেশি হওয়ায় তরুণদের অর্থের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে আত্মঘাতী বানানো হচ্ছে। জঙ্গিদের লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা এবং সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা। আমার মতে, জঙ্গি দমনে পুলিশের সর্বোচ্চ মহলে কমিটমেন্ট থাকলেও জঙ্গিদের কার্যক্রম বন্ধ করতে আপাতত থানা ও জেলা পর্যায়ে পুলিশের যে দায়বদ্ধতার প্রয়োজন আছে তা নেই। এ জন্য পুলিশের চেইন অব কমান্ড শক্তিশালী করে থানা পর্যায় পর্যন্ত পুলিশের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া প্রশাসনের মধ্যেই এমন অনেকে আছেন যারা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সমর্থক। সরকারকে এদের দিকেও নজর দিতে হবে। সর্বোপরি জঙ্গিদের দমাতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র— সব জায়গা থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের এই অধর্মের কাজ করা থেকে বিরত থাকতে ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদেও বোঝাতে হবে। এর পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক জঙ্গিবাদের কথা মাথায় রেখে আমাদের প্রশিক্ষিত বিশেষ টেরোরিজম ফোর্স গঠন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, বাংলাদেশে ১২৫টি জঙ্গিসংগঠন রয়েছে। জঙ্গিদের অর্থের সংস্থান অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন আরও ভয়াভয় সব তথ্য বের হয়ে এসেছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলো যে নামেই থাক না কেন, তাদের ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ কিন্তু জামায়াত। এ বিষয়ে এখন কোনো সন্দেহ নেই। আর সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হামলার ধরন দেখে বোঝাই যায়, আন্তর্জাতিক বিশ্বে সম্প্রদায়িক হামলা ও জঙ্গিবাদের যে অপতত্পরতা চলছে তার সঙ্গে এই জামায়াতের যোগসূত্র রয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাকে অব্যাহতির ঘটনাও সেটিই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, এটি শুধু নিরাপত্তার সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়; বরং, সামাজিক অবক্ষয় মূল্যবোধ তথা সমাজ কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর সে কারণে, কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সন্ত্রাস দমনে সবাইকে সমান ভূমিকা পালন করতে হবে। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে, শিক্ষক, সমাজসেবী, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর