রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ছয় চ্যালেঞ্জে বিএনপি

মাহমুদ আজহার

ছয় চ্যালেঞ্জে বিএনপি

রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ছয় চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন বছরে। অগোছালো সংগঠনকে পুনর্গঠন করাই এ মুহূর্তে দলটির প্রধান চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুমসহ হামলা-মামলার খড়গ ঝুলছে। আইনিভাবে এসব মোকাবিলার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সাংগঠনিক কর্মসূচির মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে দলের ভিতরেও। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিএনপির অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে টানাপড়েন সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে। পাশাপাশি দলের অবস্থানও পরিষ্কার করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করাও জরুরি।  এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের ধোঁয়াশা স্বচ্ছ করতে হবে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে নিজেদের বিতর্কমুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যাসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হলো একটা সংগঠন। কখনো কখনো তার ভুলভ্রান্তি হওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগও অতীতে অনেক ভুল করেছে। তার খেসারতও দিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব বিগত কয়েক বছরে সরকারের চাপ মোকাবিলায় নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। এখন উচিত নিজেদের সে ভুলগুলো পর্যালোচনা করা। দায়িত্বজ্ঞানহীন বাগাড়ম্বর থেকে বিরত থেকে বাস্তবসম্মত কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া। তাদের (বিএনপি) সম্পর্কে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা যে মতামত দিচ্ছেন, তার যথার্থতা খতিয়ে দেখে সেভাবে এগিয়ে যাওয়াটাই এখন বিএনপির মূল কাজ বলে আমি মনে করি।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নতুন বছরে বিএনপিকে মোটা দাগে ছয়টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ ব্যাপারে দলটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শুধু দলের জন্যই নয়, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য তা হবে শুভকর। সরকারবিরোধী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরও সমর্থন পাবে দলটি। দেশের তরুণ সমাজেরও বড় একটি অংশ তাদের সঙ্গে থাকবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক ও বিএনপি-ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী মহলের বিবেচনায় এ ছয় চ্যালেঞ্জ হলো—

১. দল গোছানো ২. রাজনৈতিক মামলা-হুলিয়া থেকে নেতা-কর্মীদের বের করে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে আনার পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। ৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন। ৪. জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের ধোঁয়াশা কাটিয়ে এ ব্যাপারে স্বচ্ছ অবস্থান গ্রহণ ৫. দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ন ও ৬. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পৌর নির্বাচনের পর বিএনপির এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে সব মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠন করা। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানো এ মুহূর্তে দলটির বড় চ্যালেঞ্জ। তিনদিকে ঘেরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে এ মুহূর্তে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ বাড়ানো উচিত।’ বিশিষ্ট এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, ‘একটি শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নশীল দেশের সামনে এগোনো খুবই কঠিন। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কোনো বিতর্ক করা সঠিক নয়। তবে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারও একটি যুক্তি আছে। তার পরও বিএনপিকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিএনপির কোনো বিতর্কে জড়ানো ঠিক নয়। সেটা মুক্তিযুদ্ধই হোক কিংবা শহীদ বুদ্ধিজীবীই হোক, এ নিয়ে নেতাদের কোনো বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত কিংবা প্রভাবশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রই নয়, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই বিএনপির আস্থার সংকট কাটাতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেখানে আওয়ামী লীগের ঘাটতি আছে, সেখানে সুযোগ নিতে হবে বিএনপিকে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধির সঙ্গেও বিএনপির হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাও জরুরি।’ সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। তবে ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট ধরে রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি দলটি। এ কারণেই লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সব সময় নিজেদের গতিশীল রাখতে হবে। রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিতে হবে। মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ দুর্বল হওয়া মানেই আমাদের গণতন্ত্রের ক্ষতি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপিকে সর্বাগ্রে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের পরামর্শকদের পুনর্গঠনও জরুরি। তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও প্রভাব দলে কী হবে, সে ব্যাপারেও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে টেকসই সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কী, তা সবার কাছে স্পষ্ট করতে হবে। সেই সঙ্গে ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়ে কোনো বিতর্ক করা ঠিক হবে না। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিতে একটি গবেষণা সেল ও পৃথক প্রচার সেল থাকাও জরুরি বলে আমি মনে করি। সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘বিএনপির দৃশ্যমান ও কার্যকর কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে যথাসম্ভব বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে দলের নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত করতে হবে। আগামী দিনে বিএনপি কী করবে, সে বিষয়েও দলের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধির সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক এখন তুলনামূলক ভালো। দেশের স্বার্থে এ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর