বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দিন যায় বছর যায় সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত শেষ হয় না

দিন যায় বছর যায় সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত শেষ হয় না

চার বছর আগে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি —ফাইল ফটো

আজ থেকে ঠিক চার বছর আগের এক সাতসকালে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাটে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির রক্তাক্ত লাশ মেলে। আঁতকে ওঠা এমন খবর শোনার পর দেশের মানুষের মনে তখন দুটি প্রশ্ন— সাগর-রুনি দম্পতির খুনি কারা? কেন তারা নৃশংস খুনের শিকার হলেন? এমন দুটি প্রশ্নের জবাবে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘স্রেফ ৪৮ ঘণ্টা, এই সময়ের মধ্যেই খুনিরা ধরা পড়বে। খুনের কারণও জানা যাবে।’ হত্যার রহস্য শুরু সেই থেকে। ৪৮ ঘণ্টার সেই আলটিমেটাম শেষ হলো না ৪৮ মাসেও। আর এই সময়ের মধ্যে সরকার বদল হয়েছে একবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন তিনজন। তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে বলে আলোচিত হওয়া সেই পুলিশপ্রধান অবসরে গেছেন। থানা থেকে দেশের বিভিন্ন সংস্থা হয়ে মামলার তদন্ত ঘুরেছে সুদূর মার্কিন মুলুক পর্যন্ত। কবর থেকে লাশ তোলা শুধু নয়, তদন্তের সব কটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু ফল শূন্য। ঘটনার পর দুটি প্রশ্নের অবস্থান যেখানে ছিল, চার বছর পরের অবস্থানও সেই একই স্থানে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তকাজ শেষ হয়নি। এটি স্পর্শকাতর মামলা। ভেবেচিন্তে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের চার বছরের মাথায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সেই পুরনো কথা আবারও বললেন। গতকাল জয়পুরহাটে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোনো সময় সাগর-রুনির হত্যার রহস্য আমরা জানতে পারব। কে, কীভাবে, কেন তাদের হত্যা করল এবং এর পেছনে কী ছিল সবই জানা যাবে। এদিকে চার বছর ধরে সাংবাদিকদের সাক্ষাত্কার দিতে দিতে হতাশ-ক্লান্ত সাগর-রুনির স্বজনরা। এখন আর এ নিয়ে কথা বলতেও চান না তারা। বিচারের আশাও ছেড়েই দিয়েছেন। তারা বলছেন, দিন যায় বছর যায়, আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয় না। মন্ত্রী বা পুলিশের ‘যে কোনো সময়’ বা ‘শিগগির’ কবে আসবে তা কেউ জানে না। মামলার বাদী ও নিহত মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, চার বছরেও যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি, তা আর কোনো দিন হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু একটিই দুঃখ, এত বড় একটি ঘটনা ঘটিয়েও খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে! তাদের শনাক্তই করতে পারল না পুলিশ-র‌্যাব। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানার পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসা থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সাংবাদিক মেহেরুন রুনির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

শুধুই আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি : ঘটনার দিন থেকেই শুধু আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে। তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দিয়েছিলেন ৪৮ ঘণ্টার প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এ সময় শেষ হওয়ার আগেই তত্কালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে’। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে ৪৮ মাসে গিয়ে ঠেকেছে, তবুও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির কোনো দেখা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিনের মাথায় ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলামও হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ’ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে মন্তব্য করেন। সে সময় তদন্ত সংস্থা ডিবি ‘গ্রিল কাটা’ চোরদের দিকে ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে ডিবি তা এড়িয়ে যায়। এ ছাড়া র‌্যাবের কাছে তদন্ত হস্তান্তরের পর ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে পাঁচজন রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিত্সক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই বছর আগস্টে গ্রেফতার করে ডিবি ও র‌্যাব। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে তাদের গ্রেফতার দেখানো ছাড়াও সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পালকেও গ্রেফতার দেখানো হয়। কিন্তু দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। পরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাগর-রুনির বাসার পলাতক দারোয়ান এনামুল হক ওরফে হুমায়ূনকে ধরতে পারলে হত্যাকাণ্ডের রহস্যজট খুলে যাবে। এ জন্য এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এনামুলকে গ্রেফতার করা হলেও খোলেনি রহস্যজট। এর আগে ২০১২ সালের ১২ জুন ও ১৭ জুলাই দুই দফায় সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। আলামতের তালিকায় ছিল হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত একটি ছুরি, ছুরির বাঁট, সাগরের মোজা, একটি কম্বল, সাগরের পরনের প্যান্ট, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট। প্রথম দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এসব আলামত থেকে দুজন ব্যক্তির সম্পূর্ণ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরে এ দুই ব্যক্তির প্রোফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর, দুই নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও এনামুল ওরফে হুমায়ূন কবীর এবং পাঁচ ডাকাত রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণের চুল ও লালা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সে সময় বলা হয়েছিল, এ আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে তদন্ত নতুন মোড় নেবে। রহস্য উদ্?ঘাটনে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। গত বছর সেই পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও হাতে পেয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা। কিন্তু সেই ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে কারও ডিএনএ ম্যাচ করেনি। ফলে অধরাই থেকে গেছে খুনিরা।

গ্রেফতার আটজনের তিনজন জামিনে : সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে মোট আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজন জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাকিরা এখনো কারাগারে। তদন্তসূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মে উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল। এর এক মাস পর ৬ জুন জামিন পান মিন্টু।

হতাশ পরিবার : চার বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় পুরোপুরি হতাশ নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তারা এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্?ঘাটন, খুনিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেফতারের আর কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না। সব কিছু ছেড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার হাতে।

সর্বশেষ খবর