শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

র‌্যাব বলল, মা খুনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

র‌্যাব বলল, মা খুনি

আটকের পর গতকাল র‌্যাব সদর দফতরে নিহত দুই শিশুর মা মাহফুজা মালেক জেসমিন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

অবিশ্বাস্য! শুধু সাধারণ মানুষ কেন, খোদ র‌্যাব কর্মকর্তারাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মা নিজ হাতে খুন করেছেন তার নাড়িছেঁড়া ধন ফুটফুটে দুই শিশু সন্তানকে! জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবেই নিজের গর্হিত কাজের কথা স্বীকার করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তাদের কাছে। যদিও রাতভর মা, বাবা এবং খালাকে জিজ্ঞাসাবাদে ‌র‌্যাব কর্মকর্তারা খুঁজেছিলেন নেপথ্য অন্য কোনো কারণ। অবশেষে মা মাহফুজা মালেক জেসমিনের এমন স্বীকারোক্তির বিষয়টি সামনে রেখে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— “সন্তানদের ভবিষ্যত্ নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার এক পর্যায়ে’ নিজের ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে ছেলেমেয়েকে হত্যা করেন ওই নারী।” গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে র‌্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। পরে জেসমিনকে আটক দেখিয়ে রামপুরা থানা পুলিশের কাছে গতকালই হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। মামলার বাদী হয়েছেন শিশুদের বাবা ব্যবসায়ী মো. আমানুল্লাহ। শুরুতে খাবারে বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর কথা বললেও ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার এ ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গত বুধবার র‌্যাব দুই শিশুর বাবা, মা ও খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। ঢাকার র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শিশু দুটির মা মাহফুজা মালেক জেসমিনের স্বীকারোক্তি আসে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান। মাহফুজা কেন তার সন্তানদের হত্যা করেছেন— সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জিজ্ঞাসাবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে দুই শিশুর মা মাহফুজা মালেক জেসমিন তার সন্তানদের ‘নিজেই হত্যা করেছেন’ বলে স্বীকার করেন। হত্যাকাণ্ডের বিবরণও তিনি বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন। কেন তিনি সন্তানদের হত্যা করেছেন তার কারণ জানতে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে ওই নারী বার বারই বলেছেন, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও ভবিষ্যত্ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় দুই শিশুর মাকে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখেছেন। ওই মহিলা ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স পাস। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জামালপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন। তবে এ পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দুই শিশুর বাবা আমানুল্লাহর সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ র্যাব এখনো পায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। জেসমিনের জবানবন্দির বরাত দিয়ে মুফতি মাহমুদ বলেন, প্রথমে আমরাও বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়টিই বেরিয়ে এসেছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি মেয়ে অরণি যখন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছিল, তার মা ও ভাই তখন শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। গৃহশিক্ষক চলে যাওয়ার পর মাহফুজা তার মেয়েকেও ঘুমাতে ডাকেন। অরণি বিছানায় যাওয়ার পর মাহফুজা তার ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মেয়ের শ্বাসরোধ করেন। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে মেয়ে বিছানা থেকে পড়ে যায়। এ সময় বুক হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকেও একইভাবে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করেন। প্রথমে তিনি ঘটনা গোপন করার জন্য স্বামীকে ফোন করে ছেলেমেয়ের অসুস্থতার কথা বলেন। আমানুল্লাহ তখন দুই বন্ধুকে বাসায় পাঠান। বাচ্চাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর পর ছেলেমেয়ের লাশের ময়নাতদন্ত করতেও আপত্তি জানিয়েছিলেন ওই মা। দুই শিশুর মধ্যে ১৪ বছর বয়সী নুসরাত জাহান অরণি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মূল শাখা) পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। আর তার ছোট ভাই আলভী আমান (৬) পড়ত হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারিতে। সোমবার রাত ৮টার দিকে রামপুরা বনশ্রীর বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিত্সক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় শিশুদের মা ও খালা দাবি করেছিলেন চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবার খেয়ে শিশু দুটির মৃত্যু হয়েছে। তবে পরদিনই ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্যের পর পাল্টে যায় চিত্র। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রথমে খুন হয় মেয়ে। পরে ছেলেকে খুন করেন পাষাণময়ী মা।

জিজ্ঞাসাবাদের কিছু অংশ : সন্তানদের কীভাবে হত্যা করলেন? তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে জেসমিন বলেন, ‘ওই রুমে আমার ছেলে এবং মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমার মেয়ে আমার ওড়নাটা ব্যবহার করত। প্রথমে ওড়না দিয়ে ওরে প্যাঁচাইয়া ধরি। তারপর মেয়ে নিচে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার পর মেয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটাকে ধরি। ছেলেও ওই সময় ঘুমানো ছিল।’ কেন হত্যা করলেন? জানতে চাইলে শিশুদের মা জেসমিন বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারবে না, কিচ্ছু পারবে না। ওদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এ বিষয়টি আমার সব সময় মনের মধ্যে শুধু ঘুরঘুর করত। অনেক কষ্ট হতো আমার। তবে এ বিষয়টি আমি আমার স্বামী কিংবা অন্য কারও কাছে শেয়ার করি নাই। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ থেকে এ বিষয়টি সব সময় আমার মাথায় কাজ করত। আমি ঘুমাতে পারতাম না।’ দুই বাচ্চা মনে হয় আপনার নয়, জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তার এমন প্রশ্নের জবাবে জেসমিন বলেন, ‘স্যার, বাচ্চা দুইটা আমার। সিজার কইরা হইছে। বাচ্চা দুইটার জন্য আমার অনেক কষ্ট হইছে। আপনারা হয়তো বলতে পারেন তুমি কান্না কর না। বাচ্চারা মারা যাওয়ার পর আমি অনেক কাঁদছি। এখন আমার চোখের পানি শুকাইয়া গেছে। এখন মনে হয় আসে না। আমার মনে হয় বাচ্চা দুইটাকে যদি আমি কাছে পাইতাম, ওদের যদি একটু জড়াইয়া ধরতে পারতাম তা হইলে মনে হয় আমার চোখের পানি আবার ফিরে আসত।’ সন্তানদের মারার পর স্বীকার করেননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জেসমিন বলেন, ‘আমি কাউকে বলি নাই। আমি বিপদ থেকে বাঁচতে চাইছিলাম। মনে করছি যা হওয়ার তা তো হইছেই। এখন যদি আমি বলি তা হইলে তো আমি ধরা পড়ে যাব। আমার ফাঁসি হবে। এখন যদি বাঁচতে পারি তাহলে নতুন করে জীবনটা আবার শুরু করতে পারব।’ দুই বাচ্চাকে হত্যা করা তার ভুল হয়েছে এমন দাবি করে জেসমিন বলেন, ‘আমার স্বামী সব সময় ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তার পরও তাকে যদি আমি বলতাম তাহলে আমাকে সে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইত। তাহলে আজ এমন ঘটনা ঘটত না।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর