বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল

আজ হরতাল, বিজিবি মোতায়েন

আহমেদ আল আমীন

মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চের পক্ষে গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রায়ে মীর কাসেমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর ফলে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর এই কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যকে। মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আপিল বিভাগের এটি সপ্তম রায়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তা নেওয়া হয় আদালত প্রাঙ্গণে। জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক খাতের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচিত এই মীর কাসেম ১৯৭১ সালে ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সংগঠন আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিচারিক আদালতে প্রমাণিত দশ অভিযোগের মধ্যে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার একাদশ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম, নবম, দশম ও চতুর্দশ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মোট ৫৮ বছরের দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগে। তবে চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দ্বাদশ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন মীর কাসেম। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকারপক্ষ। তবে আসামিপক্ষ রিভিউ করবে বলে জানিয়েছে।

এই রায় ঘোষণা উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চের পাঁচ সদস্য এজলাসে আসন গ্রহণ করেন সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন— বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার এবং বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। সরকারপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং এস এম শাহজাহান। মীর কাসেমের ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমও উপস্থিত ছিলেন আদালতে।

সপ্তম আপিলের নিষ্পত্তি : এই রায়ের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সপ্তম আপিল নিষ্পত্তি হলো আদালতে। এর আগে আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী এবং মতিউর রহমান নিজামীর আপিলের নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাঈদী ও নিজামীর মামলায় এখনো রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি। সাঈদীর রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় থাকলেও নিজামীর রিভিউর সিদ্ধান্ত হবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর। আদালতের রায় অনুযায়ী অন্যদের ফাঁসির আদেশও কার্যকর করেছে সরকার। এদের মধ্যে সাকা চৌধুরী বিএনপি নেতা এবং অন্যরা জামায়াত নেতা।

পেছন ফিরে দেখা : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেফতার হন মীর কাসেম। পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। ২০১৩ সালের ১৬ মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয় ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। ৩০ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ট্রাইব্যুনাল-২-এ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শুরু করে প্রসিকিউশন। মামলাটি ট্রাইব্যুনালে রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয় ওই বছরের ৪ মে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর আপিল করেন তিনি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি আপিলের শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি। মামলাটি তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি নুরুল ইসলাম।

যত অপরাধ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেমের বিচার হয় ১৪ অভিযোগে। তবে বিচারিক ওই আদালতে প্রমাণিত হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও চতুর্দশ— এই ১০টি অভিযোগ। এর মধ্যে একাদশ অভিযোগে সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও দ্বাদশ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। প্রমাণিত অন্য আট অভিযোগে মোট ৭২ বছরের দণ্ড পান তিনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে আপিল বিভাগে চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দ্বাদশ অভিযোগ থেকে খালাস পান মীর কাসেম। অন্য সাত অভিযোগ প্রমাণিত হয় আপিল বিভাগে। এসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডও বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় লুত্ফর রহমান ফারুককে। তৃতীয় অভিযোগ, ২২ বা ২৩ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয় ডবলমুরিং থানা এলাকার কদমতলীর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। সপ্তম অভিযোগ, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর সদস্যরা ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরীসহ দুজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে ডালিম হোটেলে। নবম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে সৈয়দ মো. এমরানসহ ছয়জনকে অপহরণ ও নির্যাতন। দশম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে মো. জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরণ ও নির্যাতন করে আলবদর সদস্যরা। একাদশ অভিযোগ, একাত্তরের ঈদুল ফিতরের পর যে কোনো এক দিন মীর কাসেমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে অপহণের পর নির্যাতন করে আলবদর সদস্যরা। নির্যাতনে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচ অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। চতুর্দশ অভিযোগ, নভেম্বরের শেষ দিকে মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর সদস্যরা নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ ও নির্যাতন করে। একাদশ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও তৃতীয়, সপ্তম, নবম ও দশম অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। আর দ্বিতীয় অভিযোগে ২০ বছর এবং চতুর্দশ অভিযোগে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় বিচারিক আদালতে।

ঘাতক থেকে ধনকুবের : ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলীর জন্ম মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। ডাকনাম পিয়ারু ওরফে মিন্টু। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন ছোটবেলায়। সেখানে জড়িত হন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৭৭ সালে নাম বদল করে তার নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রশিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এ সংগঠনটি। তিনি হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। একাত্তরে চট্টগ্রামে অবস্থানের সময় ঘাতক আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও টর্চার সেল স্থাপন করেন ডালিম হোটেল নামে পরিচিত স্থানীয় মহামায়া হোটেলে। সেখানে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার বহু সমর্থককে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল চট্টগ্রামবাসীর কাছে হত্যাপুরী হিসেবে পরিচিতি পায়। নৃশংসতার জন্য মীর কাশেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’। ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর তিনি ছিলেন তৃতীয় কমান্ডার। এই গুপ্ত ঘাতক বাহিনীতে নেতৃত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় তার অবস্থান ছিল মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পরেই। আর বিশেষভাবে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর প্রধান। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এনজিও রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর এ-দেশীয় পরিচালক হন। ইবনে সিনা ট্রাস্টসহ বহু আর্থিক, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালক মীর কাসেম আলী দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। বিগত তিন দশকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন।

রায়ে মন্তব্য নেই কাসেম আলীর : কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের  চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী গতকাল আপিল বিভাগের রায়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখার খবর কয়েক ঘণ্টা পর দুপুরে শুনেছেন। তিনি দুপুরে স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া-দাওয়া করেছেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার  নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ট্রাইব্যুনালের  দেওয়া সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন।

কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, মীর কাসেম আলী এ কারাগারের ৪০ নম্বর কনডেম সেলে রয়েছেন। গ্রেফতারের পর ২০১২ সাল থেকে তিনি এ কারাগারে রয়েছেন। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার। ২০১৪ সালের আগে তিনি হাজতবাসকালে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীর মর্যাদায় ছিলেন। দণ্ডপ্রাপ্তির পর তাকে ফাঁসির (কনডেম) সেলে পাঠানো হয়।

প্রত্যাশিত ফল পেয়েছি : যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আমরা প্রত্যাশিত ফল পেয়েছি। যুদ্ধাপরাধী নেতা ছিলেন, সেই নিজামী দণ্ডিত হয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানের যিনি সভাপতি ছিলেন, মুজাহিদ দণ্ডিত হয়েছেন। মীর কাসেম আলী দণ্ডিত না হলে ন্যায়বিচারের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হতো। আদালত তাকে সঠিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এমন প্রতিক্রিয়া জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। একাত্তরে চট্টগ্রামের বদর কমান্ডার যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য ছিল বলে মন্তব্য করেন মাহবুবে আলম। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আদালতের বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য নিয়েও কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, যারা মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন- এটা ভ্রান্ত। শেখ হাসিনা যদি না থাকতেন, নির্বাহী বিভাগে এরকম দৃঢ় মনোভাবের একজন না থাকলে এটা কিন্তু হতো না। তাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই বিচার হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলা হয়েছিল। এই বিচার এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আপসহীন ভূমিকাকে ‘প্রাণকেন্দ্র’ হিসেবে অভিহিত করে মাহবুবে আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি : আপিল বিভাগের রায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। গতকাল রায় পরবর্তী এক বিবৃতিতে মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করার কথাও জানান তিনি। খন্দকার আয়েশা খাতুন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আদালতে যে সাক্ষ্য প্রমাণ আনা হয়েছে, তা কোনোভাবেই অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট নয়। এতে বলা হয়, মামলার যুক্তিতর্ক চলার সময়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন মন্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে মীর কাসেমকে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার মতো কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বিভিন্ন মন্ত্রীর প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতিকে হুমকি, ধমকি এবং রায় প্রকাশের পূর্ব মুহূর্তে আদালত কর্তৃক বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন আমাদের মনে একটাই প্রশ্নের জন্ম দেয়, যা কিনা সারা দেশের জনগণেরও প্রশ্ন যে, বিচার বিভাগ কি আসলেই স্বাধীন?

পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর রিভিউর সিদ্ধান্ত : যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল থাকার প্রতিক্রিয়ায় তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, একজন আইনজীবী হিসেবে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা আমাকে মানতেই হবে। তবে ভবিষ্যৎ ইতিহাস এ রায় পর্যালোচনা করবে। এ মামলা চলাকালে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং মামলার অবস্থান সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আপনারা জানেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমরা রিভিউর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

জামায়াতের হরতাল আজ : জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল রাখার প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবিতে আজ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ মীর কাসেম আলীসহ আটক সব জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবি করে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। মকবুল আহমাদ বলেন, সরকার মিথ্যা, বায়বীয় ও কাল্পনিক অভিযোগে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে নিজেদের দলীয় লোকদের দ্বারা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করার ষড়যন্ত্র করছে। এ রায়ে মীর কাসেম আলী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। চট্টগ্রামের ঘটনাস্থলে তার অনুপস্থিতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকার পক্ষ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ব্যবস্থা করেছে।

সতর্ক র‌্যাব পুলিশ বিজিবি : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর রায় ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তায় ছিল উচ্চ আদালত এলাকা। জামায়াত-শিবিরের নাশকতা ঠেকাতে র‌্যাব-পুলিশের প্রস্তুতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সোমবার বিকাল থেকেই উচ্চ আদালত এলাকায় বিশেষ টহলে ছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ডগ স্কোয়াড দিয়ে আদালত চত্বরে বিশেষ সুইপিং করে র‌্যাব। সার্বক্ষণিক প্রস্তুত ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। অন্যদিকে জামায়াত-শিবিরের ডাকা আজকের হরতাল ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি। নাশকতা ঠেকাতে গতকাল সন্ধ্যা থেকেই রাজধানীতে বিশেষ নিরাপত্তায় নেমেছে ২০ প্লাটুন বিজিবি। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ২০ প্লাটুন বিজিবি নামানো হয়েছে রাজধানীতে। তবে ঢাকার বাইরে কিছু জায়গায় আরও আগে থেকেই বিজিবি মোতায়েন ছিল। প্রশাসনের চাহিদার কারণেই বিজিবি দায়িত্ব পালন করছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম অর্থদাতা মীর কাসেম আলীর রায় ঘিরে জামায়াত-শিবির বড় ধরনের নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আগাম খবরে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্দেহভাজন এলাকা ও মেসগুলোতে বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করা হয়। জামায়াত-শিবিরের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এমন স্থানগুলোতে আগে থেকেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয় র‌্যাব-পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স। পোশাকে ও সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্) কর্নেল জিয়াউল আহ্সান বলেন, যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত র‌্যাব। জানমালের ক্ষতি হবে এমন কোনো কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া হবে না। মীর কাসেম আলীর রায় ঘিরে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আগে থেকেই গোয়েন্দা তত্পরতা অব্যাহত ছিল। ডগ স্কোয়াড দিয়ে আগের দিনই বিশেষভাবে সুইপিং করানো হয় ট্রাইব্যুনালে।

উচ্চ আদালতের ডেপুটি রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী বলেন, ‘রায় ঘিরে যেন কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি কেউ তৈরি করতে না পারে, অন্যান্যবারের মতো এবারও তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন।’

গতকাল সরেজমিন শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, আবদুল গনি রোড, মাজার রোড ও উচ্চ আদালত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্ব পালন করছেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ। সকাল থেকেই এসব এলাকা অতিক্রমের সময় অধিকাংশ মানুষকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পুলিশ যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তৈরি রয়েছে। আইন ভঙ্গকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

গণজাগরণ মঞ্চের আনন্দ মিছিল : একাত্তরে গণহত্যার দায়ে আলবদর বাহিনীর অন্যতম শীর্ষনেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির আদেশ আপিল বিভাগে বহাল থাকায় আনন্দ মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল আপিল বেঞ্চের রায়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহালের খবর গণজাগরণ মঞ্চে পৌঁছালে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। এরপর শাহবাগ প্রজন্ম চত্ত্বর থেকে একটি আনন্দ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য ঘুরে পুনরায় শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখার দাবিতে সকাল ৮টা থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, মীর কাসেম আলীর ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় রাজপথে জনগণের আন্দোলন বিজয় হয়েছে। এ রায়ের মধ্যদিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর সমস্ত ষড়যন্ত্র পরাজিত হয়েছে। তিনি বলেন, জামায়াতের অর্থ প্রতিপত্তি ব্যবহার করে এ রায় প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ফাঁসির রায় বহাল রাখার মাধ্যমে আদালত আবারও প্রমাণ করলো কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত আপস করে না। এ সময় ফাঁসির আদেশ দ্রুত কার্যকরের দাবিও জানান তিনি।

কিশোরগঞ্জে আনন্দ শোভাযাত্রা, মিষ্টি বিতরণ : জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল থাকায় কিশোরগঞ্জে আনন্দ শোভাযাত্রা ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। গতকাল টেলিভিশনে ফাঁসির রায় বহাল থাকার খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে জড়ো হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় সংসদের পক্ষ থেকে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। পরে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আসাদ উল্লাহর নেতৃত্বে শোভাযাত্রায় মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।

ফাঁসির রায় বহাল থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা অবিলম্বে এ রায় কার্যকরের দাবি জানান।

যুক্তরাষ্ট্রে উল্লাস  : একাত্তরের আলবদর নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় সর্বোচ্চ আদালতেও বহাল রাখায় গতকাল নিউইয়র্ক, বস্টন, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ইলিনয় এবং মেট্রো ওয়াশিংটনের মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উল্লাস করেছেন। খবর এনআরবি নিউজের। নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সোমবার রাতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণ সমাবেশ চলার সময়ই অনলাইন সংবাদ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইট টিভিতে সর্বোচ্চ আদালতের রায় জানা যায়। তখন উপস্থিত সবাই উল্লাসে ফেটে পড়েন। এ সময় তারা একাত্তরের বর্বরতায় দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের জন্য বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এই উল্লাস পর্বে মিষ্টি খাওয়ানো হয় এবং বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলো থেকে সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর