বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিতের পর সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত হই

আবদুল্লাহ আল নোমান

পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিতের পর সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত হই

পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের পার্লামেন্ট স্থগিত করার ঘোষণার পরপরই আমরা স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হই। ১ মার্চ  ১৯৭১ সালে ওই ঘোষণার পর আমরা মনে করি, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই আমাদের দাবি আদায় করতে হবে। ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সেদিন আমরা চট্টগ্রামে লিফলেট বিতরণ করি। চট্টগ্রামে আদমজী ও আমেরিকান সেন্টারে হামলা করি। মনে আছে, জহির রায়হানের মরিচ মাইনর গাড়িটি সেদিন আমরা চট্টগ্রামে ব্যবহার করি। কাজী জাফর ভাই সেদিন চট্টগ্রামে ছিলেন। আমিসহ আন্দোলনকারীদের সাজাও দেন পাকিস্তানি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত। আমাকে সাড়ে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেননেরও সেদিন সাজা দেওয়া হয়েছিল। স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ’৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর মতো সমানভাবে দেখেনি। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভের দানা বাঁধে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ’৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যখন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলনে রাজপথে, তখনই তা স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই পরিস্থিতিতে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ওই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর দল তখন দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল, ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হবেন, আর প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ও বইছিল। এটা কীভাবে মীমাংসা হবে, রাজপথে না গোলটেবিলে— তার দিকে নজর ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উত্সুক জনতার। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার পরও যখন আওয়ামী লীগের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি করছিল পাকিস্তান জান্তারা, তখন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি নিয়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির খান ওয়ালী খানও পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। সেদিন মুজিবের দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে সংসদ বসবে, আর ভুট্টোর দাবি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পার্লামেন্ট বসার কথাও ছিল। কিন্তু এর আগেই ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে হবে। আন্দোলনকে আমরা একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়ে সেদিন থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে ট্রেনিং শুরু করি। চট্টগ্রামে সিটি কলেজের অগ্রণী ব্যাংক শাখা থেকে আমরা সেদিন কিছু অস্ত্রও লুট করি। কিন্তু ছাত্রলীগের বাধায় বেশি অস্ত্র নেওয়া সম্ভব হয়নি। লুত্ফর রহমানের ফক্সি গাড়িতে করে অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান জান্তাদের উত্খাতে আমরা সেদিন বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং নিই। এ জন্য আমরা ইন্ডিয়াও গিয়েছিলাম। তবে ২৬ মার্চ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশে গৃহযুদ্ধ লাগার শঙ্কা ছিল। ওই ঘোষণার পরই সামরিক-আধা সামরিকসহ সর্বস্তরের জনতা একটি কাঠামোয় স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা আনব—সমঝোতা নয়, শেষ পর্যন্ত আমাদের কথাই সঠিক হয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতার আন্দোলনে। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল থেকে আজ জাতি বঞ্চিত।  লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি

সর্বশেষ খবর