শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা

প্রতিদিন খুনোখুনি, হামলা-মামলা ভাঙচুর আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ছে সহিংসতা। প্রতিদিনই ঘটছে সংঘাত-সংঘর্ষ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা একে অন্যের ওপর হামলা করছেন। ঘটছে গোলাগুলি-ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও। ভাঙচুর করা হচ্ছে নির্বাচনী অফিস, প্রার্থীর বাড়িঘর, প্রচার মাইক ও যানবাহন। প্রথম ধাপের ইউপি ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, সহিংসতা ততই বেড়েই চলছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই দেশব্যাপী শুরু হয়েছে  নির্বাচনী সংঘাত। এতে সারা দেশে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতা নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কও বিরাজ করছে। এবারের ভোটের আগেই প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করছেন। এ ছাড়া বিএনপি, স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যেও সংঘর্ষ হচ্ছে অনেক এলাকায়। দলীয় নির্বাচনের কারণে এসব ঘটছে। এদিকে গতকালও ভোলা সদরের চরসামাইয়া ইউনিয়নে নির্বাচনের প্রচার শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তের হামলায় এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মোরেলগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, কুষ্টিয়ার মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সংঘর্ষে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এর আগে পিরোজপুরের নাজিরপুরে এক ছাত্রদল নেতা, পটুয়াখালীর বাউফলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ এ পর্যন্ত অন্ত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তবে প্রথম ধাপের নির্বাচনে পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাট, খুলনায় বেশি সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদেও নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র উঠে এসেছে।

ভোলায় একজন নিহত : ভোলা প্রতিনিধি জানান, নির্বাচনী সংঘর্ষে ভোলা সদরের চরসামাইয়া ইউনিয়নে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী ভোলা থানায় মেম্বার প্রার্থী জাহাঙ্গীরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। নিহতের স্ত্রী কমলা বেগম অভিযোগ করেন, তার আত্মীয় মেম্বার প্রার্থী বজলুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামায় তার প্রতিপক্ষ মেম্বার প্রার্থী জাহাঙ্গীরের লোকজন মারধর করায় তার স্বামী সিরাজ মারা গেছেন। এ জন্য থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ভোলা থানার ওসি খায়রুল কবির জানান, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে সিরাজের সঙ্গে এক বিধবার অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে শান্তিরহাট গ্রামে এলাকাবাসীর সঙ্গে সিরাজের হাতাহাতি হয়। খবর পেয়ে মেম্বার প্রার্থী বজলু এসে ঘটনা মীমাংসা করে দেন। পরে রাত ১২টার দিকে বজলুর প্রতিপক্ষ অন্য মেম্বার প্রার্থী জাহাঙ্গীর ও তার লোকজন সিরাজকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান। এ সময় মেম্বার প্রার্থী বজলু ও জাহাঙ্গীর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ওই রাতেই পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গতকাল সকালে সিরাজ নিজ বাড়িতে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। ভোলা থানা পুলিশ লাশ মর্গে পাঠায়। এদিকে বোরহানউদ্দিনে প্রতিপক্ষের হামলায় কুতবা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আনোয়ার হোসেনসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেনসহ তিনজন ভোলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, গতকাল কুতবা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফুটবল প্রতীক নিয়ে আনেয়ার হোসেন ও তার সমর্থকরা গণসংযোগ করছিলেন। এ সময় অন্য সদস্য প্রার্থী ফজলু গ্রুপ তাদের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় বোরহানউদ্দিন থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে আহত ৪০ : বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, মোল্লাহাট উপজেলায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ ৪০ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে শরণখোলায় এক যুবদল কর্মীর পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের এ সংঘর্ষে আহতদের প্রথমে মোল্লাহাট ও পরে পাশের গোপালগঞ্জ এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একই দিন সকালে শরণখোলায় নির্বাচনী সহিংসতায় মেহেদী হাসান প্রিন্স (২৬) নামে এক যুবদল কর্মীর ডান পা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা। অন্যদিকে মোরেলগঞ্জে বিএনপির দুই প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাদের ক্যাডারদের চাপে বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তারা। মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সাঈদ মোহাম্মদ খায়রুল আনাম জানান, উদয়পুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মেম্বার প্রার্থী আজিজুর রহমান ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেম্বার প্রার্থী কামরুল ইসলামের সমর্থকরা এদিন সকালে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন। মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা : মোরেলগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জিউধরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বাদশা জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টায় ভাইজোড়া ব্রিজসংলগ্ন নৌকা প্রতীকের ওই অফিসটি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করেছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। একই রাতে ১১টার দিকে হোগলাপাশা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও মেম্বার প্রার্থী মো. ফারুক মিয়ার বাড়িতে গুলি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফারুক মিয়ার প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খায়রুল আলমের বাড়িতে হামলা ও তার মেয়েকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

লক্ষ্মীপুরে সংঘর্ষ : লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। গতকাল দুপুরে তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের মুসলিমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। আহতদের কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুসলিমপাড়ায় বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিন তার সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করছিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফয়সল আহমদ রতনের সমর্থক স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের বাধা প্রদান করেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মোসলেহ উদ্দিনসহ উভয় পক্ষের পাঁচজন আহত হন। পরে এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে পাশের ফাজিল ব্যাপারীর হাটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এখানেও পাঁচজন আহত হন। প্রার্থীর ওপর হামলা : কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় পদে পদে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। ঘটছে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাও। প্রচারণার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছেন বিএনপি ও জাসদ মনোনীত প্রার্থীরা। বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হান্নানের সমর্থকরা জাসদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ওমর আলীর ওপর ককটেল ছুড়ে মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এএসআই আনিচুর রহমান বলেন, একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে জাসদ প্রার্থীকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়ার যে কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এদিকে ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার টিপু সুলতানের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন রাতের বেলা ১৫-২০টি মোটরসাইকেলে করে সশস্ত্র মহড়া দেন। এতে ভোটাররা আতঙ্কে আছেন। তালবাড়িয়া ইউনিয়নে জাসদের প্রার্থী আরিফুল ইসলাম আরিফ জানান, আওয়ামী লীগের লোকজন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন, যাতে তারা মশালের পক্ষে কাজ না করেন। প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ : নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা বাজারে চেয়ারম্যান প্রার্থী অহিদুল ইসলাম খানের পক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বেগম সেলিমা রহমানকে গণসংযোগে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে মাধবপাশা বাজারে এ ঘটনা। বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদুল ইসলাম প্রিন্স জানান, মাধবপাশা ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী পক্ষে সেলিমা রহমানের নেতৃত্বে একদল নেতা-কর্মী মাধবপাশা বাজারে গণসংযোগে যান। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা এতে বাধা দেন। অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়নাল আবেদীন জানান, সেলিমার সঙ্গে কিছু চিহ্নিত অপরাধী এলাকায় প্রবেশ করে। এতে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এদিকে হিজলা উপজেলার মেমানিয়া ইউনিয়নের টেকেরহাটে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় তছনছ ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। একই উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের মাউলতলায় বিএনপির প্রার্থীর প্রচার মাইক ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। রূপগঞ্জে সংঘর্ষ : রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, রূপগঞ্জ উপজেলায় দুই ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে গোলাকান্দাইল ও সাওঘাট এলাকায় এ ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে এক বর্ধিত সভায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মনজুর হোসেন ভুইয়াকে সমর্থন দেওয়া হয়। এস কে সোলায়মান নামে আরেকজন আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন দাবি করেন। পরে দুজনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে। ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ার হোসেন জানান, পুলিশ সময়মতো ঘটনাস্থল পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক।

সর্বশেষ খবর