শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাঠ ছাড়া বিএনপি তৃণমূলে হতাশা

মাহমুদ আজহার

‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কী হবে তা বোঝা হয়ে গেছে। নির্বাচনের সাধও মিটে গেছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হোক। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে বাড়ি থাকতে চাই’— কথাগুলো বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার হোগলাপাশা  বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মফিজুল হকের। গতকাল নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে আক্ষেপের সঙ্গে এ কথাগুলো বলেন তিনি। পাশের বনগ্রাম ইউনিয়নের প্রার্থী আবদুল জব্বার মোল্লাও একই আকুতি জানান। শুধু এ দুজনই নয়, মোরেলগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের বাইরে সব প্রার্থীরই একই বক্তব্য। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া অন্যরা নির্বাচনী মাঠে প্রচারণায় নেই বললেই চলে। কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউ আবার ঘর থেকে বেরোতেই পারছেন না। এরই মধ্যে ওই উপজেলায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চারজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে বিএনপির চালচিত্র প্রায় একই ধরনের। প্রথম ধাপে ৭৩৩ ইউপির মধ্যে অধিকাংশ এলাকায় বিএনপির প্রার্থীরা ভোটযুদ্ধে মাঠে নেই। সরকার মনোনীত প্রার্থীদের বাধার মুখে পিছু হটেছেন বিএনপির প্রার্থীরা। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন দেখেও না দেখার ভান করছে বলে দাবি বিএনপিসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও হতাশ। দল মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকেও বলা হচ্ছে, ইউপি নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত। তার পরও দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক ইউপিতে বিএনপি প্রার্থীদের মাঠে নামতেই দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনসহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগও করা হচ্ছে। কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হচ্ছে না। সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নেই। তার পরও আমরা নির্বাচনের মাঠে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকব। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলব, আপনারা দলের প্রার্থীর পক্ষে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকুন। মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির প্রার্থীদের বিজয় হবেই ইনশা আল্লাহ।’ প্রথম ধাপে ২২ মার্চ ৭৩২ ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় বাধার অভিযোগের মধ্যে এ ধাপে আওয়ামী লীগের ৬২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। নানা কারণে আরও ৫৭ ইউপিতে প্রার্থী নেই বিএনপির। মোট ৬৭০ ইউপিতে নৌকা-ধানের শীষের লড়াই হচ্ছে। এর মধ্যে একটি ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না থাকায় বাকি ৬১২ ইউপিতে নৌকা ও ধানের প্রার্থীরা লড়বেন। সরকারদলীয় প্রার্থীদের অব্যাহত হুমকি, হামলা, মহড়া এবং মামলার আতঙ্কে রয়েছেন বরিশাল জেলার ৭৪ ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। এখনো এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে অনেক প্রার্থীকে। লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় এড়িয়ে চলছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে একজন আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হোসেন লাল্টু। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে আগে থেকেই চাপ সৃষ্টি করেন একই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সোয়েব ইমতিয়াজ লিমন। এখন এলাকায় তার প্রচারণায় শুধু বাধায় নয়, নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ। গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী তাইফুর রহমান কচিকে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রার্থী কৃষ্ণকান্ত দে নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এলাকায় ঠিকমতো প্রচারণাও চালাতে পারছেন না তিনি। একইভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় ক্ষমতাসীনদের বাধা এবং কর্মীদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ করেন খাঞ্জাপুর ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী আ ক ন সিদ্দিকুর রহমান। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলতাফ সরদার ওরফে আলতুর চাপের মুখে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ায় বিএনপি মনোনীত ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী ফয়সাল চৌধুরী। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বনগ্রাম ইউনিয়নে প্রার্থী আবদুল জব্বার মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে না পারে, তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হোক। আমাদের নিরাপদে বাড়িতে থাকার অধিকারটুকু নিশ্চিত করুক। জানা গেছে, বরগুনায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হুমকিতে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সদর উপজেলার নলটোনা, ফুলঝুরি, ঢলুয়া, আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়নে প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা ও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। পাথরঘাটার ৭টি ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থীদের প্রচারণা থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণায় বাধা ও কর্মীদের মারধর করে মাইক ছিনতাই করে নেওয়া হয়েছে। বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি ও বেতাগী সদর ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করছেন। নির্বাচনে নিরাপত্তার বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, যেখানেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে সেখানেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। ঝালকাঠিতে ইউপি নির্বাচনে বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধার পাশাপাশি প্রার্থীদের সমর্থকদের বাড়ি গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার গাভা রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ এস এম শাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতির ভাগ্নের লোকজন আমার সমর্থকদের মামলা দিয়ে হয়রানির ভয় দেখাচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। সুষ্ঠু ভোট নিয়ে নানান আশঙ্কা রয়েছে।’ মগড় ইউনিয়নের বিএনপি সমর্থিত আমিনুল ইসলাম কাজী অভিযোগ করে বলেন, হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে বাধার কারণে তিনি ভোটারদের কাছে যেতে পারছেন না। যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল অভিযোগ করেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের মারপিট করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘরে হামলা করা হচ্ছে। থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ আমাদের মামলা তো নিচ্ছেই না, উল্টো আমাদের নেতা-কর্মীদের আসামি করে মামলা দিচ্ছে। যে কারণে নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা]

সর্বশেষ খবর