শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্ম চিন্তা

প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

প্রার্থনার স্বাদ

রুকু শেষ করে আসি সিজদায়, প্রার্থনার শেষবিন্দু।

লেখা যেত আরও কিছু দিন ধরে। অহর্নিশি শুনতে পাই প্রভুর আহ্বান। হওয়ার নয়। ইতিমধ্যেই শুরু বকাবকি। লেখা তো আমার মতোই  হবে; ভিন্ন; আল্লাহর উপলব্ধি সঞ্জাত। মঞ্চ থেকে নিষ্কৃতি নিলাম। সিজদায় যখন, চিন্তা করতে হবে যে রোবট নই, নই মেশিন। স্রষ্টার কাছে নিবেদন, অন্তরতম প্রবেশ থেকে এমন কিছু, যা আগে উপলব্ধি করিনি। স্রষ্টাকে জিজ্ঞাসা, আমার কাছে কি চাও? কিছুই নেই অশ্রুজলে অবগাহিত কিছু প্রণতি। এই সিজদা, আকুল প্রাণের আশা, পরিপূর্ণ সমর্পণ। সম্মান দিয়েছ, মুখ এখন নত মাটিতে তোমারই উদ্দেশ্যে। ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’। অশ্রুজলে জানাই শেষ প্রণতি। তুমি আমার সবকিছু। কিছুই চাওয়ার নেই, ক্ষমা ছাড়া। প্রার্থনা ভুলে বসে আছি, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, অশ্রুজলই সে ভাষা। এই হূদয় তন্নতন্ন করে খুঁজে পাবে শুধু তোমার পরাক্রান্ত নাম। যদি পড় দেখবে আমি তোমার, তুমি আমার। নিশ্চুপ মাটির ঢেলার মতো পড়ে আছি। তোমার কাছ থেকে যে উপহার আমি প্রত্যাশী তা হলো : তোমার ক্ষমা।

সমর্পণই পরিপূর্ণ প্রশান্তির উপায়। কীভাবে? নিজকে জিজ্ঞাসা করি, জান্নাত কোথায়, যা প্রশান্তির সবচেয়ে বড় আধার। সাত আসমানের উপরে আল্লাহর কাছাকাছি। দোজখই বা কোথায়? সবচেয়ে নিচে, আল্লাহর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরত্বে যার অবস্থান। সবচেয়ে আনন্দের আধার আল্লাহর কাছেই : ‘ফেরদৌস আল আলা’। মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করেছি মনের বাগানে ‘ফেরদৌস আল আলা’। সেখানে প্রিয় নবী, যার অবস্থানের নিচেই কল্পনা রাজ্যের সিংহাসন, স্রষ্টার কুরসি। কল্পনায় কেমন করে আসবে, যেমনটি পিপীলিকার কল্পনায় আসে না শহর, গ্রহ গ্রহান্তর, চন্দ্র-সূর্য। জ্ঞানহীন মানুষের কল্পনা নাগাল পায় না তার। কুরসির মধ্যে সমাসীন যিনি, সেই প্রভুর কল্পনাও যে অনেক দূরের। এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করি, নবী (সা.) যখন দুঃসহকাল অতিবাহিত করছিলেন মক্কায়, যখন দুঃখে তিনি ভারাক্রান্ত, তখন আল্লাহতায়ালা কীভাবে ভরিয়ে তুলেছিলেন তাকে পরিপূর্ণ প্রশান্তি দিয়ে, টেনে তুলেছিলেন হতাশার গভীরতা থেকে, দিয়েছিলেন এমন এক অরুণ আশার সূর্যোদয়, যা পৃথিবীর আর কাউকে দেননি। টেনে নিয়েছিলেন মিরাজ শরিফে, এমন একজন মানুষকে যার চেয়ে বেশি কাছে আর কাউকে নেননি। প্রভুর কাছে ছিল তার আশ্রয়। আল্লাহ বলছেন : ‘তার দিকেই পবিত্র বাণীসমূহ সমুত্থিত হয় এবং সত্কর্ম ওকে উন্নীত করে’। [সুরা আল ফাতির : ১০] তা হলে সুখ কি? সুখ আল্লাহর কাছে। যত আল্লাহর কাছে যাব, তত আনন্দ ও সুখ আমাকে আচ্ছন্ন করবে কারণ তিনিই রাজা, তিনি সুখের মালিক। তার উচ্চতায় যেতে হলে যতখানি নত হওয়া সম্ভব ততখানি হতে হবে। বলে থাকি, নত করব না শির কিছুতেই। নত হব না চিরশত্রু শয়তানের কাছে, অপশক্তির কাছে, অন্যায়ের কাছে। যে যত নত, ততখানি উন্নত সে।

নবী (সা.) বলছেন : ‘যে আল্লাহর কাছে বিনীত, আল্লাহ তাকে উপরে উঠান’, দেন তাকে সম্মান, ভরে দেন আনন্দ দিয়ে তার জীবন। পরীক্ষা করুন নিজে। নত হন সারা দিন যতবার সম্ভব, নিজকে উঠান পঙ্ক থেকে সুউচ্চে। এটি হবেই, হতেই হবে। উনি সর্বক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। এটাই সত্য, আর সব মিথ্যা। হাদিসে আছে : ‘বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে কাছে, যখন সে সিজদায়রত’। মনে করি, সুরা ‘আলাক’-এর শেষ সুরায় আল্লাহ কি বলছেন : ‘সাবধান থেক! ওদের অনুসরণকারী হইও না। সিজদা দাও আমারই কাছে। চলে এসো আমার অতি কাছে’ [রাজত্বে]। সম্ভব হলে পড়ুন : ‘স্পষ্ট জ্যোতি আল কুরআন’ পৃষ্ঠা-৫৩৯ থেকে ৫৪০। স্পষ্ট হবে ‘আলাক’ অর্থাৎ জমাটবাঁধা রক্তপিণ্ডের রহস্য, কীভাবে জন্ম, বৈজ্ঞানিকরা কী বলছেন। রসুল (সা.) বলছেন : ‘সিজদা দাও, কারণ একেকটি সিজদায় আল্লাহ তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দিচ্ছেন বেহেশতের পানে, আর পাপের ভার কীভাবে লঘু করে দিচ্ছেন। তার কুরসি চলে আসছে তোমার সন্নিকটে।

আরও প্রমাণ চাই? রাবিয়া ইবনে কা’ব একদিন রসুল (সা.)-কে অজুর পানি এগিয়ে দিচ্ছেন। রসুল (সা.) তার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন, ‘কিছু চাও’? কা’ব বললেন : ‘তোমার সঙ্গে বেহেশতে যেতে চাই’। রসুল (সা.) বললেন : ‘আর কিছু’? রাবিয়া বললেন : ‘এইটুকু, আর কিছু নয়’। রসুল (সা.) বললেন : ‘তা হলে আমাকে সাহায্য কর, [সেখানে যেতে] বেশি বেশি করে সিজদা দাও’। কত সহজ বেহেশতের দিকে যাত্রা। আত্মাকে যত উপরে উঠাব তত যাত্রা সহজ হবে। কীভাবে আত্মাকে উপরে উঠাব? কেন, সিজদা দিতে পারব না? এবার যখন সিজদা দেব শুধু দেহ নয়, মন, আত্মা সবাইকে নিয়ে সিজদায় সমাসীন হব। সিজদার অপর প্রান্তে কুরসি। কুরসি অনুভব করুন। প্রতিদিন এই সুজুদ নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হবে। সবার প্রয়োজন প্রভুকে। অন্য মনস্কতা আর নয়। অন্তর এখন ভালোবাসায় সিক্ত। পরিপূর্ণ সিজদার অনুভূতি একদম আলাদা। নূর দিয়ে তা আচ্ছন্ন। যেমনটি লেখা আছে কোরআনে ‘আল-ফাতহ’ সুরাতে : ‘তাদের লক্ষণ মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরস্ফুিট, তওরাতে তাদের বর্ণনা এভাবে এবং ইঞ্জিলেও’। [৪৮:২৯] [স্পষ্ট জ্যোতি আল কুরআন, পৃষ্ঠা-৪৪৭] এটা সেই চিহ্ন, যা খুঁজে ফিরি মসজিদে মসজিদে। সহূদয় ব্যক্তি এরাই, করুণা দিয়ে মাখা এদেরই ব্যক্তিত্ব। দেখলে নির্ঘাত বোঝা যাবে এরা বেহেশতি, মর্তের খেলাঘরে বেড়াতে এসেছে কয়েক দিনের জন্যে, যেমনটি বলেছেন নবী (সা.)। দুনিয়াতে তিনি একজন পথিকমাত্র, চলে যাবেন কোন পার থেকে কোন পারে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে শত মানুষের সঙ্গে মুসাহেবা করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। নাত হামদ শুনিয়েছি। বাবাও তাই। আমার মতে শ্রেষ্ঠ মানুষ এরাই। সবচেয়ে সুখী। কম খান, কম ঘুমান এবং কম উপভোগ করেন। মসজিদে যান না যারা, তারাও ভালো আছেন বৈকি। খাচ্ছেন নানা পাখির গোশত, সামনে উন্মুক্ত পৃথিবীর হাট-বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, উপভোগের নানা সম্ভার। কেউ বা আজানে বিরক্ত। আজাবের সম্ভার ক্রয়ে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই, জাগতিক স্বাদ আয়ত্তাধীন। সুজুদ জানতে হলে কোরআন জানতে হয়, জানতে হয় হাদিস, চিনতে হয় ইসলাম। মুহাম্মদ (সা.)-কে সবার জন্যে আল্লাহ রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন, শুধু মুসলমানদের জন্যে নয়। তিনি ‘রহমাতুল্লিল আল-আমিন’। কে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবেন, তা একমাত্র আল্লাহতায়ালার জানা। অবকাশ নেই ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার। হতে হবে উদার, কাউকে আঘাত করার জন্যে উদ্যত নয়। হলে এই জমিনে ইসলাম আসত না। তরবারি নয়, ভালোবাসাই আমাদের প্রথম ও শেষ মন্ত্র। সিজদার জন্যে মুখ নামানোর মুহূর্তে অবশ্যই ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে হবে। হাতের তালু যেন আগে ভূমি স্পর্শ করে, অন্য প্রাণীরা যেমন হাঁটু আগে স্পর্শ করে তেমন নয়, প্রথমে মাথা অল্প একটু ভূমি স্পর্শ করবে, তারপর পুরো মাথা নাকসহ ভূমির মধ্যে স্থির হবে। হাতের তালু ভালোভাবে ভূমি স্পর্শ করবে। আঙ্গুলগুলো হাঁটু, পায়ের গোড়ালি কিবলার দিকে স্থির থাকবে। কনুই ভূমি থেকে আলাদা হবে [পশুদের মতো ভূমির সঙ্গে লেগে থাকবে না], পেট ঊরু থেকে আলাদা থাকবে। সিজদা একটি প্রক্রিয়া। যেনতেনভাবে হবে না। শরীরের সাতটি অংশ এর সঙ্গে যুক্ত, কপাল-নাকসহ দুই হাতের হাঁটু এবং দুই পায়ের গোড়ালি অচঞ্চল থাকবে। প্রতি হাড় এবং জয়েন্ট থাকবে শান্ত ও সংহিত। সিজদায় রসুল (সা.) কোরআন পড়তেন না। এটি দোয়ার মুহূর্ত। আমাদের শেখানো হয়েছে যে দোয়া সেগুলো হলো : ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ [তিন বার]। আরও পড়া যায় : ‘সুবহানাক আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া বিহামদিক আল্লাহুম্মা ইগফারলি। এর সঙ্গে পড়ুন সুবহুন কুদ্দুসন রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রুহ’। দোয়া অর্থ আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা। আল্লাহতায়ালা মুসা নবীর সঙ্গে তুবা উপত্যকায় যে কথা বলেছিলেন স্মরণে আছে? পড়ুন, সুরা তা’ হা। [স্পষ্ট জ্যোতি আল কুরআন, পৃষ্ঠা-২৬৭ থেকে ২৭৬] ব-নড়ড়শ [.িংবরনড়র.পড়স] আল্লাহ মুসাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার দক্ষিণ হাতে ওটা কি’? মুসা আল্লাহর এই বাক্য শুনে খুবই আনন্দিত বোধ করলেন, বললেন : ‘এটি আমার লাঠি, এতে আমি ভর দি এবং এটা দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষ পালের জন্যে গাছের পাতা সংগ্রহ করি। এটি আমার অন্যান্য কাজেও লাগে’। সিজদায় গিয়ে মুসা নবীর সঙ্গে আল্লাহতায়ালার কথোপকথনের এই মুহূর্তটির চিন্তা আপনাকে আনন্দ দেবে। তার সঙ্গে কথা বলুন, আপনার সমস্ত ভার তাকে দিন, বিমুক্ত হন সংসারের জটিল আবর্ত থেকে। এক রুকুতে একটি সালাত, সিজদা দুটো, কারণ কি? কারণ সিজদায়ই সালাতের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ। যেন দুটি স্তম্ভ, যেন একটাই যথেষ্ট নয়। রসুল (সা.)-এর সিজদা হতো দীর্ঘ। কারণ এটাই সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত, পাওয়ার মুহূর্ত এবং জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কারও কারও জীবন বড় আনন্দময়। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সালাতের মাধুর্যে পরিপূর্ণ। যারা জীবন্ত, তারা সালাতেই জীবন্ত। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করছেন, কাজেকর্মে চিন্তার স্রোতে প্রবাহিত : আল্লাহ। সমর্পণের পথ খুঁজুন, জীবন হবে আনন্দময়। 

 

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব। ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর