শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

গণহত্যার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করি

ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ

গণহত্যার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করি

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় সেনাবাহিনী দমন অভিযান চালিয়ে গণহত্যা করছে— এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সর্বপ্রথম অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করি। এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মেজর জিয়াউর রহমান। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল ক্যাপ্টেন আহমদ আলী, লে. আজম, লে. হুমায়ুন এবং ইপিআরের (পরে বিডিআর) মেজর আবদুল হামিদ ও ক্যাপ্টেন নজর। নৌবাহিনীরও বিভিন্ন পদাধিকারী ১০ জন এ বিদ্রোহে প্রাণ হারান। এ বিদ্রোহ ক্ষণিকের কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত। এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই লোমহর্ষক। তখন আমি চট্টগ্রাম অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কোয়ার্টার মাস্টার। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক লে. কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আমার ছিল ঘনিষ্ঠতা। একসময় তিনি আমার অধিনায়ক ছিলেন। সেই সুবাদে ’৭০-এর নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই আমরা আলাপ-আলোচনা করতাম। তার অজানতে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও আমার আলোচনা হতো। তারা একে অন্যকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন না। এমনকি মেজর জিয়ার সঙ্গেও আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। পাশাপাশি অফিস থাকায় ও কোয়ার্টার মাস্টার হওয়ার কারণে মেজর জিয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, পাকিস্তান আর্মির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে। সৈনিক হয়েও আমরা জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি, সব কিছুর ঊর্ধ্বে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ এবং জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিই। নিজের জীবনের কোনো পরোয়া ছিল না। এখানে বলে রাখা দরকার, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন শুধু একটা রাজনৈতিক ব্যাপার ছিল না। সে নির্বাচন ছিল কার্যত তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে। নিঃসন্দেহে এর ভিত রচনা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পাকিস্তানিদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, জেনারেলরা শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী পদে মেনে নেবেন না। পাকিস্তানি জেনারেলদের এই মনোভাবের বিষয়টি এবং অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের প্রস্তুতির বিষয়টি আমরা জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানাই। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি জেনারেলরা আপনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবেন না। আপনার কাছে ক্ষমতাও হস্তান্তর করবেন না। আমাদের যুক্তি ছিল দুটি। একটি হলো, যদি আপনি (শেখ মুজিব) প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে পাকিস্তানি জেনারেলদের হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা। আরেকটি হলো, ’৬৫-র যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নতুন কোনো দল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে দেখিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে দেখছি নতুন নতুন সেনাদল আসছে। সুতরাং একটি বিষয় আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে তারা শক্তি প্রয়োগ করে দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এ জন্য তাদের সময় দরকার। তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে নেবে। আলোচনার টেবিলে রফা না হলে তারা শক্তি প্রয়োগ করে জনগণকে দমন করবে। ১৮ মার্চ আমরা চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা এম আর সিদ্দিকীর মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুকে ভিতরে ভিতরে বাঙালি সৈনিকদের প্রস্তুতির কথা আবারও জানাই। কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলে দিলেন, ‘না, বাঙালি সেনাদের কোনো সাহায্য আমার প্রয়োজন নাই।’ এক ইয়াহিয়া খানের পরিবর্তে আরেক ইয়াহিয়া খানকে চাই না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। তিনি ১৮ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত রমনায় প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সকাল-বিকাল বৈঠক করে গেলেন। আমরা রাজনৈতিক নেতাদের চূড়ান্ত অবস্থান দেখার এবং অন্যদিকে বিদ্রোহ করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ আমরা নিশ্চিত ছিলাম, পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তাই ভিতরে ভিতরে আমাদের পাল্টা প্রস্তুতি চলছিল। ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সশস্ত্র বিদ্রোহ করি। এরপর দখল করলাম মেজর জিয়ার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র। ২৭ মার্চ বেতার থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমি পাশে বসা ছিলাম। জিয়া জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন। ওই বিদ্রোহে আমাদের নেতা ছিলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করায় বিদ্রোহের নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তায় তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। এ ঘোষণা দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হওয়ার জন্য সব পক্ষকে বহুমাত্রিক প্রেরণা জোগায়, জনগণ দিকনির্দেশনা পায়। হতাশাগ্রস্ত জাতি আশ্বস্ত হয়। তার এ ঘোষণা জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৭১ সালে দেশের আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কথা বিবেচনায় ছিল না। বিবেচনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। সে জন্যই দেশের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করত। কিন্তু আজ সব কিছুই বিভক্তভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এখন এক মুক্তিযোদ্ধার অন্য মুক্তিযোদ্ধার বাসায় যাওয়া তো দূরকথা মুখ দেখাদেখিও বন্ধ।

সর্বশেষ খবর