রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

লোপাট হচ্ছে দলিল-ভুয়া এফডিআরের মাধ্যমেও

মানিক মুনতাসির

ভুয়া এফডিআর আর দলিল-দস্তাবেজ মর্টগেজ হিসেবে জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাটের ঘটনা কমছেই না। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাত থেকেই গত কয়েক বছরে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। ঢিলেঢালা তদারকির কারণে এ ধরনের একটার পর একটা কেলেঙ্কারি ঘটছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (এফডিআর) সার্টিফিকেটের বিপরীতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এবং কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। অনেকে এটাকে বলছেন, ‘ব্যাংক ডাকাতি’। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ মনিটরিং নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে জবাবদিহিতা না থাকায় জড়িত কর্মকর্তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। ঋণ জালিয়াতির ঘটনা রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংকেই ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এফডিআরের বিপরীতে ঋণ দিতে বাধ্য করে একটি চক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে যে কোনো ঋণ দেওয়ার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া আছে। এফডিআর সার্টিফিকেটের বিপরীতে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। অতীতে এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটলেও এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই জালিয়াতির ঘটনা কমেছে।’ সূত্র জানায়, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা জানতে পারার পর সুনাম ক্ষুণ্নের ভয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো তা প্রকাশ করে না। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে কোনো কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে বলেও জানা যায়। তবে সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনায় কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছে। পাশাপাশি যে কোনো ধরনের ঋণ দেওয়ার আগে মর্টগেজের কাগজপত্র অধিক যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেওআইসি (তোমার গ্রাহককে জানো) নিশ্চিত না হয়ে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ব্যাংকগুলো সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে চললে এবং কেওআইসি অনুসরণ করলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এ জন্য ব্যাংকারদের স্বচ্ছতা, সচেতনতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এসব ঘটনার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে অনিয়মের পাহাড় জমেছে। ব্যাংকের দৈনন্দিক কাজে চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েছে। ফলে জালিয়াতি বাড়ছেই। সূত্র মতে, সরকারের অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় আইসিবি ইসলামী ও রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংক থেকে ২০০৯ থেকে ২০১১ দুই অর্থবছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গত বছর ৮ মার্চ একটি বেসরকারি ব্যাংকে কানাডা প্রবাসী একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এফডিআরের ৯০ কোটি টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় ১১ জনকে আটকও করা হয় সে সময়। এদিকে, শুধু ভুয়া এফডিআরই নয়, ব্যাংকিং খাতের দুর্বল নজরদারির কারণে সাধারণ মানুষের জমানো বিপুল পরিমাণ টাকা অসাধু ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করছে। বন্ধকী সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও ভুয়া এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জালিয়াত চক্র। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়েছে। ভুয়া দলিল, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নেওয়ার কারণে পাঁচ বছর পর তা ‘মন্দ ঋণে’ পরিণত হচ্ছে। বিপুল এই খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে প্রতারক চক্রের হাত থেকে রক্ষা পায় বেসরকারি ব্যাংকটি। এ ধরনের আরও একাধিক অভিযোগ নিয়ে তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরেক পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ ও ২০১৩ সালে বৃহৎ আকারে এলসি জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেও একই ধরনের বেনামে এলসি খুলে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। এলসি জালিয়াতিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন খাত। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্য ছাড়াও ব্যাক টু ব্যাক এলসির সঙ্গে জড়িত গার্মেন্ট, জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সম্প্রতি অখ্যাত তিনটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত বছর মার্চে কয়েকটি ব্যাংকের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। অপরিশোধিত চিনি আমদানির নামে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও আরও কয়েকটি অখ্যাত গ্রুপ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার এলসি জালিয়াতি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি বিভাগ ও পরিদর্শন বিভাগ যৌথভাবে এ ঘটনা তদন্ত করে দুদকের কাছে নথি পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়ও এসব ঘটতে পারে। তাই সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় এগুলো ঘটতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকগুলো একটু নড়েচড়ে বসেছে। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।’

সর্বশেষ খবর