রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

বগি দিয়ে কুমিল্লা শহরের প্রবেশমুখ বন্ধ করি

অধ্যক্ষ আফজল খান

বগি দিয়ে কুমিল্লা শহরের প্রবেশমুখ বন্ধ করি

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা শহরের প্রবেশমুখ শাসনগাছা রেলক্রসিং মালবাহী ট্রেনের বগি এনে বন্ধ করি। পাশের কুমিল্লা রেলস্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করেন। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক  ধরে আসা পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশের সময় প্রাথমিক বাধা পায়। তবে তারা ক্রেন দিয়ে সেগুলো সরিয়ে ফেলে। ওই রাতে তারা পুলিশ লাইনে এসে হামলা করে। এতে অনেক পুলিশ সদস্য হতাহত হন। আমরা ২৬ মার্চ কুমিল্লা ছেড়ে যাই। আবদুল মালেক এমপিসহ কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী কলমচূড়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিই। রাতে আমাদের একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। পাশের কক্ষে ছিল গরু-ছাগল বাঁধা। উৎকট গন্ধ আর মশার কামড়ে ঘুম আসছিল না। মালেক ভাইকে বললাম, বিছানা নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে ঘুমাই। কিন্তু সেখানেও মশা। মশা মারতে মারতে রাত পার। পরদিন ভারতের ত্রিপুরায় প্রবেশ করি। সেখানে দেখি বুড়িচংয়ের এমপি সুলতান আহমেদ একটি গাড়িতে যাচ্ছেন। তিনি ডাক দিয়ে আমাদেরও তুলে নিলেন। সোনামুড়া গিয়ে স্থানীয় যুব কংগ্রেস নেতা নন্দলাল সাহার বাড়িতে উঠি। সেখানে দুই দিন থাকি। তারপর মুগ্গারপাড় এলাকায় মালেক ভাইকে রেখে আমি কাঁঠালিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যাই। এখানে বলে রাখি, আমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি, তখন আমার বাড়িতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে। আমার বাবা সাদেক খান পালিয়ে বাঁচেন। আমার চাচা মোসাদ্দেক খান গুলিবিদ্ধ হন। আমার স্ত্রী নার্গিস খান ও তিন মাসের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা কুমিল্লার দাউদকান্দিতে আমার বড় ভাই মেনু খানের শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর বোনের শ্বশুরবাড়ি চান্দিনার মহিচাইলে চলে যান। দুই মাস পর স্ত্রীকে ভারতে নিয়ে যাই। ভারতের কাঁঠালিয়ায় এক মাসের মতো প্রশিক্ষণ নিই। যুদ্ধের সময় আমি কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে লিখছি, ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় গিয়েছিলেন। সেখানে অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী চাচার বাসায় তিনি ওঠেন। আমাকে দেখে বলেন, ‘আফজল, খবর কী?’ আমি বলি, ‘এলএলবি শেষ করেছি।’ তখন তিনি চাচার মেয়েদের খাতা নিয়ে তাতে লিখে দেন, আমি শহর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করব। বঙ্গবন্ধুর হাতে তখন একটি ছোট ক্যামেরা থাকত। পরে একজনকে ডেকে তিনি বলেন, ‘আফজলের সঙ্গে আমার ছবি তোলো।’ সেই ছবিটি আমি এখনো যত্ন করে রেখেছি। রাজনীতি করার কারণে আমার সঙ্গে পিস্তল থাকত। এর ব্যবহারও জানতাম। তবে কাঁঠালিয়ার প্রশিক্ষণে গ্রেনেডের ব্যবহার শিখি। আমার ভারী স্বাস্থ্য ছিল। ভারতীয় এক সেনা কর্মকর্তা আমার পেটে হাত দিয়ে হেসে বলতেন, ‘ইয়ে তো মুদিদোকানি হ্যায়!’ ভারত থেকে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নোয়াপাড়ার পাশের ব্রিজটি আমরা উড়িয়ে দিই, যেন ফেনী থেকে পাকিস্তানিরা আসতে না পারে। পরে চৌদ্দগ্রাম থানার পাশে পুকুরপাড়ে পাকিস্তানিরা বাঙ্কার করে। এর মধ্যে ভারতীয় সেনাদের গাড়িতে করে কুমিল্লা শহর থেকে সোনামুড়ায় খাবার, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে যাই কয়েক দফা। চৌদ্দগ্রাম সীমান্তে অবস্থানের সময় ক্যাপ্টেন আমিন বললেন, শুধু ডাল-ভাত খেয়ে যোদ্ধারা শক্তি পাবে না। তাদের জন্য ভালো খাবার দরকার। পরে কয়েকজন সিপাহি নিয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়ি থেকে চারটি গরু নিয়ে আসি। গরু দেখে লে. ইমামুজ্জামান রেগে যান। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি, ডাকাতি নয়।’ পরে দুটি গরু ফেরত দিয়ে আসি। চৌদ্দগ্রামের বাতিসা এলাকার ব্রিজে পাকিস্তানি বাহিনীর খাবারের গাড়িতে হামলা করতে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে যাই। ব্রিজের গোড়ায় মাটির নিচে বোমা রাখা হয়। একটি গাড়ি বোমায় উড়ে গেলেও অন্যগুলো অক্ষত থেকে যায়। আমরা পাশে ধানখেতের আলের পাশে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে অনেকে পিছু হটে। কয়েকজন মারাও যায়। আমি আলের আড়ালে পড়ে থাকি। পাকিস্তানিরা আর পাঁচ হাত এগোলে আমিও ধরা পড়ে যাই। মে মাসে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটক বাজার-সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। তিন শতাধিক পাকিস্তানি আর্মি বোরকা গায়ে দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় তারা প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাদের অনেক সৈনিক নিহত হয়। অনেকে পালিয়ে বাঁচে। আমি ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমারা ক্যাম্পের চিফ ছিলাম। যুদ্ধ শেষ অবস্থায় চিন্তা হতো—পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দেবে কি না। সেই বঙ্গবন্ধু জীবিত ফিরলেন। তবে দেশের শত্রুদের হাতে প্রাণ হারালেন তিনি। আরও ছয়-সাত বছর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে সমৃদ্ধিশালী দেশ থাকত। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ গঠনের কাজ পুরোদমে করে যাচ্ছেন। আশা করছি বাংলাদেশ শিগগিরই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

সর্বশেষ খবর