সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
বাঁশখালী নিয়ে কেরানীগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী

উদ্ভট কথা বলে মানুষের জীবন নেওয়া হলো

রফিকুল ইসলাম রনি, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে

উদ্ভট কথা বলে মানুষের জীবন নেওয়া হলো

কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে গতকাল নবনির্মিত কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম দরকার বিদ্যুৎ। আজকাল বিদ্যুৎ উত্পাদন করতে গেলেই আবার একদল আন্দোলনে নামে পরিবেশ রক্ষার নামে। কিছু উদ্ভট চিন্তাভাবনা এ দেশের মানুষের আছে। আমি জানি না এসব কীভাবে আসে!’ বাঁশখালীর সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের উদ্ভট কথা বলে অযথা কিছু মানুষের জীবন পর্যন্ত নিয়ে নেওয়া হলো। আমি জানি না উদ্দেশ্যটা কী। আমরা যত দ্রুত বিদ্যুৎ উত্পাদন করে সবাইকে একটু স্বস্তি দিয়েছিলাম। এখন সেই উত্পাদনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা। অথচ এটা আমাদের উন্নয়নের জন্য দরকার।’ গতকাল কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। শেখ    হাসিনা বলেন, ‘প্রথমবার যখন আমি ’৯৬ সালে ক্ষমতায় ছিলাম, তখনই দিনাজপুরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। সেখানে দুটো বিদ্যুেকন্দ্র আছে। তৃতীয়টার কাজ চলছে। এলাকার কোনো ক্ষতি হয়নি বরং জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান-পান হচ্ছে, গাছপালা হচ্ছে, সব হচ্ছে। মানুষ বসবাস করছে। ওই এলাকায় কোনো ক্ষতি হয়নি। কিছু উদ্ভট চিন্তাভাবনা এ দেশের মানুষের আছে। এগুলো কোথা থেকে আসা জানি না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অক্সফোর্ডসহ সারা বিশ্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র আছে। এ ধরনের বিদ্যুেকন্দ্রের ছাই সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বলা হয়ে থাকে অ্যাসিড-বৃষ্টি হবে। এসব ভাবনা কোথা থেকে আসে জানি না। দ্রুত বিদ্যুৎ উত্পাদন করে সরকার মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। তাতে বাধা দিতেই এ ধরনের চেষ্টা করা হয়।’ কয়লাবাহী কার্গো ডুবে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একদল বলল, পানি নাকি দূষিত হয়ে গেছে। এটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত জানি না। কারণ ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাসার পানির ফিল্টারে কয়লা দেওয়া পাত্র ছিল। সেখান থেকে কয়েক স্তরে গিয়ে পানি বিশুদ্ধ হতো। গ্রামেও এ ধরনের ফিল্টার আমরা দিয়ে থাকি। কয়লা পানিকে বিশুদ্ধ করে।’ যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার দুই ধারে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় ঢাকা-৩ আসনের (কেরানীগঞ্জ) এমপি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা কেরানীগঞ্জে এবং আওয়ামী লীগ নেতা ড. আওলাদ হোসেনের নেতৃত্বে শ্যামপুর-কদমতলীর নেতা-কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ঢাকা-৪ আসনের  এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে কারাভবনের সামনে পৌঁছালে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। পরে কারারক্ষীদের একটি চৌকস দলের অভিবাদন গ্রহণ শেষে সুইচ টিপে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রধানমন্ত্রী কারাগার প্রাঙ্গণে একটি গাছের চারা রোপণ করেন এবং উদ্বোধন উপলক্ষে কেক কাটেন। প্রতিটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সোলার প্যানেল লাগানোসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দেন তিনি। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান এবং কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ। এ সময় স্থানীয় এমপি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উপস্থিত ছিলেন।

কারাগার বন্দীখানা নয়, হবে সংশোধনাগার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের কারাগারগুলোকে কেবল বন্দীদের আটক রাখার স্থান নয়, সংশোধনাগারে পরিণত করা হবে, যাতে প্রত্যেকে সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারেন। অপরাধীদের অপরাধ করার মানসিকতা দূর করে তাদের কর্মমুখী জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। জাতির পিতা আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য এ কারাগার যেন একটি সংশোধনাগার হিসেবে বন্দীসেবা দিতে পারে। যারা জঘন্য অপরাধী, তাদের কথা আমি বলব না। যাদের মানুষ হওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাদের যেন সংশোধনের সুযোগটা করে দিতে পারি।’ তিনি অপরাধ সংঘটনের কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘অনেকের অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। এ ছাড়া এখন নতুন নতুন অপরাধ দেখা দিচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে আর অপরাধ প্রবণতাতেও আসছে ভিন্নতা। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা থেকে সরিয়ে এনে সংশোধন করা। সংশোধন করে তার জীবনটা কর্মমুখী করার ব্যবস্থা করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারাগার শুধু বন্দীখানা নয়, সেখানে অপরাধীদের সংশোধন করার পদক্ষেপটা নিতে হবে। সেদিকে আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। ছিঁচকে চুরির অপরাধে কেউ জেলখানায় আসার পর যাতে পাকা চোর হওয়ার ট্রেনিং না পায় সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। কারাগারেই অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। সেটি কারাগারেই তারা তৈরি করতে পারবেন, উত্পাদন করতে পারবেন। এগুলো বাজারজাত করার ফলে যে আয় হবে তা থেকে উত্পাদনকারী কয়েদিদের মজুরি দেওয়া হবে। এই মজুরি তাদের জন্য জমা থাকবে। প্রয়োজনে কয়েদিরা তাদের পরিবারকেও এর কিছুটা অংশ যেন পাঠাতে পারেন, এর ব্যবস্থাটাও করে দিতে হবে।’ তিনি বলেন, কয়েদিদের মাসে একবার পাবলিক টেলিফোনের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলে তাদের সংশোধনে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জমানো কিছু সঞ্চয় নিয়ে কয়েদিরা মুক্তি পেলে বাকি জীবনটা কিছু করে খেতে পারবেন। আর অপরাধের পথে পা বাড়াবেন না। একজন অপরাধ করে। কিন্তু কষ্ট পায় তার গোটা পরিবার। প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কারণে জাতির জনকের বারবার কারাগারে থাকার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘কেউ কারাগারে থাকলে, আসল ভুক্তভোগী হয় তার পরিবার। আমার মতো এই কষ্টটা হাড়ে হাড়ে আর কেউ বুঝবে না। একটানা দুই বছর তিনি কখনো কারাগারের বাইরে থাকেননি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষের কল্যাণ করতে গিয়ে জাতির পিতাকে সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। জাতীয় চার নেতাকে কারাগারেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।’ কেরানীগঞ্জ কারাগার দ্রুত নির্মিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। ছোটবেলার কথা মনে করে তিনি বলেন, কারাগারের সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্কই হয়ে গেছে। কারণ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের অসংখ্যবার কারাগারে আসতে হয়েছে। স্কুল, কলেজ শেষে কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গেছেন। সে সময় ১৫ দিনে এক দিন তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাবন্দীদের মানবেতর পরিবেশে বসবাস করতে হয়। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার মুঘল আমলে দুর্গের আদলে তৈরি। যেখানে ঘোড়াশাল থেকে শুরু করে অনেক কিছু ছিল। ব্রিটিশ আমলে এটিকে কারাগারে রূপান্তর করা হয়। এরপর পাকিস্তান আমলে এটি পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তর হয়। কাজেই এটি কারাগারের আদলে তৈরি হয়নি। যেখানে মাত্র আড়াই হাজার লোকের ধারণক্ষমতা, সেখানে হাজার হাজার বন্দী অত্যন্ত মানবেতরভাবে জীবনযাপন করতেন।

সমাজ সংস্কারে শিক্ষা প্রয়োজন : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অপরাধীদের অপরাধকর্ম থেকে সরিয়ে আনতে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ সংস্কার করতে গেলে মন-মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ জন্য দরকার শিক্ষা। আমরা বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ একটি শিক্ষিত জাতিই পারে দারিদ্র্য দূর করতে। শিক্ষা ছাড়া আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। সুতরাং সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চিকিৎসাসেবায় আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি বলে আজ এ সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আমরা খাদ্য উত্পাদনে এখন উদ্বৃত্ত দেশ। অতিদরিদ্রদের আমরা বিনা পয়সায়ও খাদ্য দিয়ে থাকি। অথচ এ দেশকে একসময় অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইতে হতো। আজকে আল্লাহর রহমতে আর ভিক্ষা চাইতে হয় না। দেশকে আমরা আরও উন্নত করতে চাই।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর