সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাঁশখালীর ঘটনায় নেপথ্যে বিএনপি জামায়াত

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ছাড়পত্রসহ নেওয়া হয়েছে অনুমোদন

রিয়াজ হায়দার, চট্টগ্রাম

এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান সুসংহত করার প্রতিযোগিতার কারণে বাঁশখালী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী একটি পক্ষ। আর এতে ‘আগুনে ঘি ঢালা’র মতো পরিস্থিতি তৈরি করে অত্যাসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে-বিপক্ষে কিংবা ভূমিহারাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া না দেওয়ার গুজব, উসকানি বা দ্রোহের নেপথ্যে এসব কারণই রয়েছে। ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে এমন বিষয়ই বেরিয়ে এসেছে।

তথ্যানুসন্ধানে প্রকাশ, ৬০০ একর ভূমির ওপর ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাক্কলিত এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অনেক আগে থেকেই এস আলম গ্রুপ ভূমি ক্রয় করতে থাকে। শুরু থেকে বিবাদ তেমন দৃশ্যমান না হলেও ইউপি নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে এলাকার পরিস্থিতি। এর নেপথ্যে সরকার ও বিরোধী দলের দুই পক্ষেরই দুটি অংশ জড়িত বলেও স্থানীয়দের অনেকের অভিযোগে উঠে এসেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। অনুসন্ধানে প্রকাশ, গণ্ডামারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিপক্ষে স্থানীয়দের প্রকাশ্যেই সংঘবদ্ধ করে সমাবেশের উদ্যোক্তা ছিলেন বিএনপি নেতা, সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। ঘটনার পর করা তিন মামলার একটিতে তাকেই প্রধান আসামি করা হয়। জেলা প্রশাসক মেসবাহ উদ্দিন বলেন, আসন্ন ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ মাঠ বাজিমাত করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে প্রশাসন সতর্ক অবস্থায় থাকবে। আর কোনো ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে না। বাঁশখালীর সাবেক এমপি ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইউপি নির্বাচন ঘিরে কথিত আন্দোলনকারী বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী এলাকায় নিজের অবস্থান সুসংহত করতে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছেন। গতকাল রাতে মাহমুদুল ইসলাম জানান, কথিত আন্দোলনকারীরা একলা চলো নীতিতে কোনো কমিটি ছাড়াই আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চেয়েছেন। শুক্রবার অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে এলাকাবাসী গণ্ডমারা বাঁচানোর লক্ষ্যে কমিটি করতে চাইলে ওই বিএনপি নেতা বাধা দেন। অবশ্য গতকাল গণ্ডামারা বাঁচাও আন্দোলন নামে এলাকাবাসী একটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানান সাবেক এই এমপি। এদিকে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দাফতরিক ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সরকারি নিয়ম মেনেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এ প্রকল্প। অন্যদিকে এলাকাজুড়ে সরকারবিরোধী একটি পক্ষের জোর অবস্থানের বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাংশের পাল্টা অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা আদৌ ছিল কি না, কিংবা এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থান পুলিশ প্রশাসনকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ করেছে কি না, তা নিয়েও ছড়িয়ে পড়েছে নানা প্রশ্ন। এ ছাড়া বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের একটি অংশ এলাকায় এবং ফেসবুকে এ নিয়ে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিসহ দায়িত্বশীলরা প্রায় এক ঘণ্টা বিক্ষুব্ধদের চতুষ্পার্শ্ব ঘেরাওয়ে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পুলিশ এই জিম্মিকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কঠোর হতে বাধ্য হয় বলে ঘটনার দিনই জানান বাঁশখালী থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার। ঘটনাটির সঙ্গে আসন্ন ইউপি নির্বাচনের যোগসূত্র থাকার কথাও স্বীকার করেন ওসি। বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য ইউপি নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে এই হতাহতের ঘটনার সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করা হয়েছে। উপজেলার সংসদীয় আসন থেকে ইতিপূর্বে একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক এমপি এবং সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ঘটনাটির সঙ্গে কোনো দলীয় রাজনৈতিক বিরোধিতার যোগসূত্র নেই।’ বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী অবশ্য বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক বা নির্বাচনী উদ্দেশ্য নয়, জনগণের ন্যায্য আন্দোলনে শরিক হয়েছি।’ স্থানীয়রা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন বিষয়ে আলোচ্য বিএনপি নেতার সঙ্গে একটি পক্ষের ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে একটি লিফলেটও প্রায় এক মাস আগে থেকেই বিলি হয় এলাকায়। লিফলেটে লেনদেনের চেক নম্বরও উল্লেখ করা হয়। শহরের বিভিন্ন স্থানে লিফলেটটি প্রচার হয়। ফেসবুকেও এ নিয়ে চলে তোলপাড়। ওই বিএনপি নেতা অবশ্য এ নিয়ে এত দিনেও কোনো প্রতিবাদ বা ব্যাখ্যা দেননি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা লিয়াকত প্রায় দুই মাস ধরে হঠাৎ এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠলে স্থানীয়দের মধ্যে আসন্ন নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ বিষয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে তার বিপক্ষে সম্ভাব্য তিন প্রার্থীর নামও সমানে আলোচিত হতে থাকে। আলোচ্য তিন সম্ভাব্য প্রার্থীই একে অন্যের বিরুদ্ধে কৌশলী অবস্থানে রয়েছেন। বাঁশখালীর ওসি জানান, বিএনপি নেতা লিয়াকত আগে থেকেই কয়েকটি মামলার আসামি। বিএনপির একাংশের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী সমাবেশের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের একাংশ ও পুলিশি অবস্থান না থাকলে রক্তপাতের ঘটনা এড়ানো যেত— স্থানীয়দের অনেকের এমন বক্তব্যকে নাকচ করে দেন ওসি স্বপন কুমার মজুমদার। তার মতে, ‘পুলিশ সমাবেশস্থলে না গেলে আরও ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো।’ ওসি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন ঘিরে যখন সাজ সাজ রব, তখনই উত্তেজনা ও গুজব ছড়িয়ে অঘটন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।’ স্থানীয়রা জানান, বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জেলা প্রশাসনের ভূমি অফিস বন্দোবস্তকৃত ভূমির মধ্যে মাত্র ১৫০ পরিবারের অবস্থান স্বীকার করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেরই ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি থেকে বাদ পড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে এবং এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। উল্লেখ্য, ঘটনার দিন সোমবার গণ্ডামারায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান ও পুলিশি অ্যাকশনে গতকাল পর্যন্ত চারজনের লাশের হদিস মেলে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সমাবেশে অন্তত চার হাজার মানুষ মুখোমুখি হন। চায়না সেবকা এইচটিজির সঙ্গে এস আলমের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেশে বেসরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রের ৭০ শতাংশের মালিকানা এস আলম গ্রুপের।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর