মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মান নেই সরকারি কাজে

বাঁশ দিয়ে হয় ভবন নির্মাণ । ভালো ইট বালু সুরকির ব্যবহার নেই । কমিশন ভাগাভাগি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মান নেই সরকারি কাজে

রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার কাথাচুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন গত অর্থবছরে নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর বা এলজিইডি। ৩৭ লাখ টাকায় ভবন নির্মাণের কাজ করেছেন ঠিকাদার মো. জুয়েল মিয়া। উদ্বোধনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সূচি নির্ধারণের আগেই খসে পড়া শুরু হয় ভবনের পলস্তারা। উদ্বোধনের আগে স্থানীয়রা দেখতে পান এক তলা  ভবনের পিলার, মেঝে, দেয়াল, ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল। পরে তাড়াহুড়া করে ঠিকাদারকে দিয়ে ফাটল ঢেকে দেন এলজিইডির কর্মকর্তারা। কিন্তু উদ্বোধনের কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখা যায় সেই ফাটল। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর খসে পড়ে ছাদ ও দেয়ালের পলস্তারা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের যোগসাজশেই নিম্নমানের কাজ হয়েছে। কারণ, নির্মাণের সময়ই নানা অনিয়মের বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু উদ্বোধনের আগে ধসে পড়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভূমিকম্প হওয়ার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় প্রধান কার‌্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় উপজেলা এলজিইডি অফিস। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা শিক্ষা কর্মকর্তার অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে স্থানীয় হেলেনাবাদ-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো ভবন। তিন কক্ষবিশিষ্ট ওই জরাজীর্ণ ভবনের পলস্তারা খসে প্রাণহানির শঙ্কা দেখা দেওয়ায় গত ২৯ ডিসেম্বর সংস্কারের টেন্ডার আহ্বান করে এলজিইডি। আগে একবার পরিত্যক্ত ঘোষিত হওয়া এ ভবন ভেঙে নতুন করে বানানোর প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় সংস্কারের টেন্ডার সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে পায় মেসার্স কলি এন্টারপ্রাইজ। গত মাসের শেষার্ধে শুরু হওয়া এ সংস্কারকাজ এখনো চলছে। টেন্ডারে পলস্তারা লাগানোর পাশাপাশি ৩৯টি কাজের দায়িত্বের মধ্যে সিলিং ফ্যান লাগানোর কথাও রয়েছে। ঠিকাদার তার প্রস্তাবে মাত্র ৪০০ টাকায় নতুন সিলিং ফ্যান কেনার শর্ত দেখিয়ে কাজ পেয়েছেন। অথচ ৪০০ টাকায় বাংলাদেশে শুধু এখন নয় ২০ বছর আগেও নতুন সিলিং ফ্যান পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেই অদ্ভুত প্রস্তাবেই চলছে জরাজীর্ণ ভবনের সংস্কারকাজ। সমঝোতার মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়া ঠিকাদারেরও এ নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই ভবনে কাজ করা এক কর্মচারী বললেন, ‘ঠিকাদার ৪০০ টাকা ফ্যানের দাম ধরেছেন এবং প্রকৌশলীরাও তাকেই কাজ দিয়েছেন। এতেই কাজের মান বিশেষ করে ব্যবহার হতে যাওয়া রড-সিমেন্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে। এখানে থেকে আর মরতে চাই না, চেষ্টা করছি অন্য কোথাও চলে যেতে।’ জানা যায়, উদ্বোধনের আগেই ভবন ধসে পড়া বা সমঝোতার মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী ঠিকাদারদের টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা বছরের পর বছর ধরেই চলে আসছে। কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই সরকারি টেন্ডারে চলছে দুর্নীতি। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের এ যৌথ অপকর্মই যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে গত মাসের শুরুতে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা পৌর ভবনের পাশে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার‌্যালয়ের নতুন পাঁচ তলা ভবনের নির্মাণকাজ উদ্বোধন হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জয় ইন্টারন্যাশনাল আড়াই কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। কিন্তু ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ঢালাই করতে দেখতে পায় স্থানীয়রা। নির্মাণাধীন ভবনের পাশের বাড়ির মালিক পরান মিয়া, নাহিদ পারভেজসহ এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেন ঠিকাদারের লোকজনকে। পরে উত্তেজিত জনতা ঢালাই ও পিলার ভেঙে ফেলে। বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্মাণকাজ। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। অবশ্য গতকাল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। কিন্তু গতকালই দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে বাঁশ ব্যবহারের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফরিদুর রহমান।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায় রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড়ের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের মেঘডুমুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণের ঢালাইয়ে রডের বদলে বাঁশ এবং স্কুলের বেঞ্চের লোহার কাঠামো ব্যবহার করা অবস্থায় নির্মাণশ্রমিকদের হাতেনাতে ধরে ফেলে এলাকাবাসী। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে নির্মাণাধীন সাড়ে ৮ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ করছিলেন ঠিকাদার আবদুল খালেক। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদারের নির্দেশে শ্রমিকরা শুধু রাতেই ঢালাইয়ের কাজ করতেন। রাতে স্কুলকক্ষে থাকা শ্রমিকরা বেঞ্চ ভেঙে ঢালাইয়ের কাজেও লাগান। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের জেলার শীর্ষ প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে শৌচাগার ভেঙে পুনরায় বানানোর ঘোষণা দেন। ইতিমধ্যেই গঠিত দুই কমিটি এ ঘটনার তদন্ত শুরু করছে।

সরকারি কাজের এমন শোচনীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবকাঠামো উন্নয়নসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারদের কাজের মানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা গত কয়েক বছর থেকেই কঠোর অবস্থানে আছেন। এর মধ্যে গত দুই মাসেই সিনিয়র তিনজন মন্ত্রী ও ঢাকার একজন মেয়র প্রকৌশলী-জনপ্রতিনিধিদের অন্তত এক ডজন অনুষ্ঠানে সরকারি প্রকল্পের মান নিয়ে কোনো ধরনের আপস সহ্য করা হবে না বলে সতর্ক করেছেন। তার পরও রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের মতো ঘটনায় তারা বিব্রত। তবে ইতিমধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের অধিদফতরের কেউ জড়িত থাকলে তদন্তের পর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত মাসেই সরকারি কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি জড়িতদের শাস্তির বিধান করতে বলেছেন। এর এক সপ্তাহের মাথায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকৌশলীদের আন্তরিকতা ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসজুড়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কমপক্ষে তিনটি অনুষ্ঠানে সরকারি কাজের মান রক্ষার জন্য জনপ্রতিনিধিদের সজাগ থাকার কথা বলেন। এমনকি গত মাসের শেষার্ধে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও রাজধানীর কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শন করে কাজের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে স্থানীয়রা যেন সরাসরি তার কাছে অভিযোগ করেন এমন কথা বলে আসেন। এত কিছুর পরও টেন্ডারে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, রাজনীতির অপপ্রয়োগ ও নিয়োজিতদের দক্ষতার অভাবে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট প্রকৌশলী ও সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর