জয়পুরহাট সদরের ভাদশা ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লড়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন এ কে আজাদ নামে এক যুবক। ভোটের লড়াইয়ে বিজয়ী হলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ দিতে হলো তার। এলাকার ভোটারসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রশ্ন— আজাদ হত্যার বিচার কি হবে? গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত নৈশপ্রহরী লেবু মণ্ডল। তার স্ত্রী শাহিদা বেগমের প্রশ্ন— ‘আমার স্বামী তো রাজনীতি করে না, তাহলে কেন গুলি খেয়ে মরতে হলো? আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’ এদিকে গতকালও নির্বাচনী সহিংসতায় নাটোরের সিংড়ায় রেজাউল করিম নামে এক কৃষক নিহত হন। শুধু ওই দুজনই নন, সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় গতকাল পর্যন্ত প্রাণ গেছে ১৪২ জনের। আদৌ কি এসব হত্যার বিচার হবে— ঘুরেফিরে এমন প্রশ্নই সবার।
জানা যায়, নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপির পাশাপাশি নিরীহ সাধারণ মানুষও রয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলেরই শতাধিক নেতা-কর্মী। তাদের পরিবারে এখনো চলছে মাতম। কেউই পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন না। তারা না পাচ্ছেন আইনি সহায়তা, না পাচ্ছেন রাজনৈতিক সমর্থন। ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। অতীতেও রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যার বিচার পাওয়ার নজির নেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের বাইরে বিজয়ী চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নিহত পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে মামলাও নিতে চাচ্ছে না পুলিশ। যারা প্রাণ হারালেন তাদের পরিবারগুলো এখনো নানাভাবে হুমকি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তা নির্বাচনী সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪২ হত্যার দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। কারণ এগুলো সরাসরি মার্ডার কেস, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়। নির্বাচন কমিশন এর দায় এড়াতে পারে না। সরকারেরও দায় আছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করা। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশকে নির্দেশ নেওয়া। আমরা যখন নির্বাচন কমিশনে ছিলাম, সব ঘটনারই তদন্ত করেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থাও নিয়েছে।’ নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, সংঘাত-অনিয়মের নির্বাচনে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয় হয়েছে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি, যা ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনের ব্যয়ের তিন গুণেরও বেশি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এত টাকা ব্যয়ে নির্বাচন হলেও ১৪২ জনের প্রাণ হারানো মানে নির্বাচন কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। দায় তাদেরও নিতে হবে।৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাজী শুভ নামে আট বছরের এক শিশু মারা যায়। সিএনজি চালক বাবা হালিম কাজীর হাত ধরে ভোট দেখতে গিয়েছিল শুভ। কিন্তু তার ফেরা হয়নি। এ নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় শুভর বাবা হালিমের সঙ্গে। কিন্তু ভয়ে তিনি কথা বলতেও রাজি হননি।
একই দিনে যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নে দুই ইউপি সদস্যের গোলাগুলিতে আবদুস সাত্তার বিশে নামে এক ফেরিওয়ালা নিহত হন। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। প্রথমে ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআই বায়েজীদ তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও পরে মামলা পাঠানো হয় সিআইডিতে। কার্যক্রম চলছে শ্লথ গতিতে। ফেরিওয়ালা হত্যার ন্যায়বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পরিবার। এ নিয়ে পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা।
১৯ এপ্রিল রাতে মিঠাপুকুর উপজেলার কাফ্রিখাল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন ও ফখরুল ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দুই দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আবদুল হান্নান (৩০)। এ ঘটনায় মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। এ হত্যার বিচার পাবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় পরিবারের। ৭ মে চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে রাজশাহীর বাগমারার আউচপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিদ্দিকুর রহমান (২৪) ও মুনতাজ (৪২)। তারা দুজনই আওয়ামী লীগের কর্মী। কিন্তু দুই গ্রুপই আওয়ামী লীগের হওয়ায় এ ঘটনা এখন ধামাচাপা পড়ে গেছে।
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের পরে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় ১২ এপ্রিল আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী মো. আসিফ (২১)। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৭ এপ্রিল মারা যান কোলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত এই সভাপতি। তাকে হত্যার ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু আসিফের বন্ধুদের অভিযোগ— তার মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। খোদ ক্ষমতাসীন দলের কর্মী হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি নিহতের পরিবারের খোঁজখবরও নিচ্ছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। আসিফের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার ছেলের সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় ছেলেটি মারা গেল, আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। এ বিষয়ে আমি বেশ কয়েক দফায় থানায় মামলা করতে গেলেও থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে বরং আমার ছেলের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের লাভের বিনিময়ে মিথ্যা মামলা নেয়।
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ইউপি নির্বাচনে ধানগড়া ইউপির জয়ানপুর গ্রামে মেম্বার পদে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে বিজয়ী প্রার্থীর শাশুড়ি নওনাই বেগম নিহতের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। এ ছাড়া ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত সুস্পষ্ট না থাকায় নমুনাগুলো ভিসেরা রিপোর্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় নির্মম পরিণতির শিকার হয়েছেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান মণ্ডল। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবদুস সোবাহান মণ্ডল দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ১৩ মে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থক-কর্মীদের হামলায় সোবহান মণ্ডলসহ তার সমর্থকদের মারধর করে সোবহান মণ্ডলের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব মৃত্য্যুর দায় তাহলে কার— প্রশ্ন রেখে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, ‘কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। কিন্তু এভাবে নির্বাচনের নামে সহিংসতা ও অনিয়ম চলতে পারে না।’