শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আঁতাত নয় জঙ্গি অর্থায়নে

জিরো টলারেন্সে সরকার । অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

নিজস্ব প্রতিবেদক

জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। জঙ্গি অর্থায়নে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা বা আঁতাতের তথ্য পাওয়া গেলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা বা যে কোনো স্তরের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংস্থার জঙ্গি অর্থায়নে ন্যূনতম সহযোগিতার তথ্য পেলে সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ জোগানদাতাদের চিহ্নিত এবং জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে ব্যাংকে লেনদেন কঠোরভাবে মনিটর করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তত্পরতায় পৃষ্ঠপোষকরা দেশে ও দেশের বাইরে অর্থ স্থানান্তরে এখনো ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করছে। এজন্য ব্যাংকের লেনদেন নিবিড়ভাবে মনিটর করা উচিত এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নকারীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, জঙ্গি বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় নয়। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন ঠেকাতে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত দুটি কমিটি কাজ করে। একটির প্রধান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং আরেকটির প্রধান আমি নিজে। দুুটি কমিটিই অর্থসংক্রান্ত ফাইন্ডিংসগুলো পাঠিয়ে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। পরবর্তী কাজগুলো নির্ভর করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর।’ তবে জঙ্গিসংক্রান্ত  বিষয়ে সবার অবস্থানই এক বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে : ‘কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থের অস্বাভাবিক লেনদেন পরিলক্ষিত হলে বা অনুরূপ কোনো হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অবহিত করে। কোথাও জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে।’ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আটটি ব্যাংকে থাকা মোট ৩৫টি হিসাবের মাধ্যমে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে জঙ্গিদের কাছে বড় অঙ্কের টাকা এসেছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও মেইনটেন্যান্স চার্জের নামে এসব টাকা লেনদেন করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছেন প্রবাসী অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী। পাশাপাশি দেশীয় বেশ কিছু এনজিও বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে এসে জঙ্গিদের অর্থায়ন করছে। আবার এ দেশ থেকে অর্থ জঙ্গি অর্থায়নের নামে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ব্যবসায়ীরাও জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করছেন। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও মনিটরিং কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থায়ন ঠেকাতে সন্দেহভাজন সব লেনদেন খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮টি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সরাসরি এ নির্দেশনার কথা জানিয়েছেন গভর্নর। অবশ্য ব্যাংকগুলোর সিইওদের সম্প্রতি এক বৈঠকে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এসব নির্দেশনা পরিপালনের জন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা ব্যাংকের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে বিপর্যয় আনতে পারে।’ শুধু বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেই নয়, কার্যত দেশের ৫৬টি তফসিলি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্ক করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের পরিপালনের জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও চেয়ারম্যানের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব গাইডলাইন পালন করার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগও পাওয়া গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোয় সন্ত্রাসী অর্থায়ন বন্ধের পরিবর্তে আরও উসকে দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেছেন, চিহ্নিত ১৮ জঙ্গির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এসব জঙ্গি ও জঙ্গি হিসেবে সন্দেহভাজনদের আত্মীয়স্বজনদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নজরদারি ও লেনদেন সম্পর্কে তদারকি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন নজরদারির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব জঙ্গির লেনদেনের তথ্যাবলি সংগ্রহ করা হচ্ছে। কঠোরভাবে এগুলো তদারকি করা হবে। জঙ্গিদের আত্মীয়স্বজনদের অ্যাকাউন্টে কোনো ধরনের সন্দেহজনক কিছু পেলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে জড়িত তাদের ব্যাংক হিসাবগুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। তারা কীভাবে, কত টাকা লেনদেন করেছে, এসব অর্থের উৎস কী, জঙ্গিদের আত্মীয়স্বজনদের অ্যাকাউন্টগুলোও খতিয়ে দেখা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য ব্যাংকগুলোর এটা খুব সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত। কারণ গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে আস্থার মাধ্যমেই লেনদেন হয়। সে ক্ষেত্রে যদি গ্রাহক ব্যাংকিং লেনদেনে হয়রানির আশঙ্কা করেন তাতে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে। তাতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে গোপনে করা, ফলাও করে প্রচার না করে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যান্য দেশে বড় অঙ্কের অর্থ জমা দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে করা হয়। আমাদের এখানেও এভাবেই করা উচিত। তিনি বলেন, ব্যাংকিং লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে ব্যাংকগুলো সচেতন হলেই বেশি কার্যকর হবে। জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক হাদিস উদ্দীন বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির কাছ থেকেও আসতে পারে। তবে ওই তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু তদন্ত। তদন্তে সম্পৃক্ততা পেলে তদন্তকারী দলের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থায়ন বন্ধে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা উচিত। এসব ব্যাপারে সময় ক্ষেপণ কখনো ঠিক নয়। গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও বাড়ানো উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের দেশেই নয়, জঙ্গি বর্তমানে বৈশ্বিক ইস্যু। দেশ তথা দেশের মানুষকে নিরাপদ রাখতে দেশের সব কটি গোয়েন্দা সংস্থার উচিত আগাম তথ্য সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা।’ এ ব্যাপারে অধস্তন গোয়েন্দা সদস্যদের কঠোর মনিটরিংয়ে রাখার ব্যাপারে মত দেন সাবেক আইজিপি। বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আলহাজ মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে, জঙ্গিদের অর্থায়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে তাদের বিরুদ্ধে আলেমসমাজকেই সোচ্চার থাকতে হবে। আর যেসব আলেম হঠাৎ করে বিত্ত-বৈভবের মালিক হন তাদের সম্পদের খোঁজখবর নিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর