শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

চোরাগোপ্তা হামলা অভিযানে বিপর্যস্ত সেনা-পুলিশ

সাঈদুর রহমান রিমন

চোরাগোপ্তা হামলা অভিযানে বিপর্যস্ত সেনা-পুলিশ

সীমিত অস্ত্র, অল্প জনবল নিয়েও প্রতিরোধযোদ্ধারা যখন একের পর এক থানা ও বিডিআর ক্যাম্প দখল করে নিল, তখন সেনাসাঁজোয়া বাহিনী হাজির হলো হালুয়াঘাট, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায়। তারা বিডিআরের পোশাক পরে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টানা যুদ্ধ চালাতে থাকল। শুরু হলো হেলিকপ্টার থেকে ফায়ারিং, শেল নিক্ষেপ, গ্রেনেড নিক্ষেপ। নদীপথে আনা হলো বিপুলসংখ্যক সেনা-স্পিডবোট। কিন্তু পাহাড়ি উপত্যকা আর গহীন অরণ্যের ফাঁকফোকর থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিচালিত চোরাগোপ্তা হামলায় তারাও বেসামাল হয়ে পড়েন। এর পরই বিডিআর, পুলিশ, সেনারা আশপাশের আদিবাসী পল্লীতে একযোগে শুরু করে বেপরোয়া নির্যাতন। ফলে একাত্তরের মতো দল বেঁধে বাড়িঘর ছেড়ে জীবন নিয়ে পালাতে শুরু করে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ। প্রতিরোধযোদ্ধাদের তত্ত্বাবধানে সীমান্তের ওপারে শরণার্থী শিবির বানিয়ে দেওয়া হয় তাদের। অন্য কোনো জায়গা থেকে সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়ায় শরণার্থী শিবিরে খাবার সরবরাহের দায়িত্বও পালন করতে হয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের।

থানা ও ক্যাম্প দখল : যুদ্ধ চলাকালে দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন তোফায়েল মৃধা ও কলমাকান্দা থানার আশরাফ আলী। প্রতিরোধযোদ্ধারা অভিযান চালিয়ে কলমাকান্দা থানা দখল করে নেন। নিজেদের ক্যাম্পে ফেরার সময় ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি তারা ওসি আশরাফ আলী ও তার স্ত্রী সুলতানা আশরাফকে আটক করে নিয়ে যান। ১৯ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানা আক্রমণকালে ওসি তোফায়েলসহ আটজন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়ে পালান। বাকিরাও হাতিয়ার ফেলে পালিয়ে যান। পরদিনই রংরার সেক্টর কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিকের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা অকস্মাৎ হানা দেন বারোমারী ও ফারাংপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে। মাত্র কয়েক মিনিটের যুদ্ধেই তা প্রতিরোধযোদ্ধারা দখলে নিতে সক্ষম হন। এ দুই ক্যাম্প থেকে জিতেন্দ্র ভৌমিক বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের জোগান দিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হন। ওই যুদ্ধে বিডিআরের বেশ কিছু সদস্য প্রাণ হারালেও প্রতিরোধযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন মাত্র  আটজন। এই দুই বিডিআর ক্যাম্প দখলে রাখা অবস্থায় দিন সাতেক পর বিডিআরের পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দলে দলে সেখানে বাঙ্কার বানিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতিতে যুদ্ধে নামেন। তাদের জোগান হিসেবে থাকে হেলিকপ্টার। শুরু হয় মরণঘাতী যুদ্ধ। এত যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ঝাঁক ঝাঁক গুলি, প্রশিক্ষিত সেনাদের ‘সামনে চলো’ নীতির যুদ্ধ, তবু প্রতিরোধযোদ্ধাদের যেন একচুলও নড়াতে পারছিলেন না তারা। রীতিমতো ব্যাংকার বানিয়ে সুরক্ষিত অবস্থানও নেন প্রতিরোধযোদ্ধারা। সেখানে কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিকের একটিই নির্দেশ ছিল—হয় জয়, না হয় মৃত্যু। জিতেন্দ্র ভৌমিক একাধারে সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধ অভিযানে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদান, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি নিজেই ধান শুকিয়ে তা চাল বানিয়ে রান্নার আয়োজন করতেন। বারোমারী বিডিআর ক্যাম্পের হাবিলদার এবং বিজয়পুর ক্যাম্পের সুবেদার বাদী হয়ে প্রতিরোধযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দুর্গাপুর থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ দুষ্কৃতকারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাতের আঁধারে হামলা চালায় এবং সহস্রাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর থানা দখলের ব্যাপারে দুর্গাপুর থানায় আরও চারটি মামলা হয়।

পত্রপত্রিকায় প্রতিরোধযুদ্ধ : ১৯৭৬ সালের ২০-২১ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা প্রতিরোধযুদ্ধের খবর বেশ ফলাও করে প্রকাশ করে। এদিন পত্রিকার হেডিং ছিল—‘কংশ নদীর উত্তরাংশের ৩০০ বর্গমাইল এলাকা বাঘা বাহিনীর দখলে শেখ মুজিব হত্যার প্রতিরোধ চলছে’। গাফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত বাংলার ডাক, কবি নির্মলেন্দু গুণ সম্পাদিত বিন্দু বিন্দু রক্ত এবং অধ্যাপক সুদীপ চক্রবর্তী সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা সোনার বাংলায় নিয়মিত প্রতিরোধযুদ্ধের খবর প্রকাশিত হতো।

অগ্রণী ভূমিকায় আদিবাসীরা : এই বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে বাঙালিদের পাশাপাশি আদিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৩৬ জন কমান্ডারের মধ্যে চার কমান্ডার ছিলেন আদিবাসী। এরা হচ্ছেন—দীপংকর তালুকদার (বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী), পংকজ আজিম, আলবার্ট ম্রং ও প্রবোধ দিও। এ ছাড়া নরবাট ম্রং, হরিষ সাংমা, চিত্ত সাংমা, মনোজ সাংমা, তরুণ সাংমা, রঞ্জিত সাংমা, জয়েশ্বর বর্মণ, সুদর্শন সাংমা, প্রদীপ সাংমা, প্রাণবল্লভ বর্মণ, সন্যাস হাজং, অমায়ুষ চিসিম, হলুদ আজিম কমান্ডার তালিকার সদস্য ছিলেন। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি অপারেশনে আদিবাসীরা বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হাশমী যুগল মাসুদ বলেন, প্রতিরোধযোদ্ধাদের ৩০ ভাগই ছিলেন আদিবাসী। তারা সে সময় বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যে দায়িত্ব দেওয়া হতো তা পরিপূর্ণভাবে পালন করতেন তারা। প্রতিরোধযোদ্ধা সুসং দুর্গাপুরের যতীন্দ্র সাংমা জানান, পঁচাত্তরের অক্টোবরে আরও অনেক আদিবাসীর মতো তিনিও যোগ দেন সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, ধোবাউড়াসহ বিভিন্ন স্থানে আট-নয়টি যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ভবানীপুরের যুদ্ধে সহযোদ্ধা ডমিনিক চাম্বুগং তার চোখের সামনেই শহীদ হন। তিনি বলেন, ‘কিছু পাওয়ার জন্য সেদিন প্রতিরোধযুদ্ধে যাইনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিলাম।’ সুসং দুর্গাপুরের হাজং মাতা রাশিমণি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মতিলাল হাজং বলেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকার আদিবাসীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় সেখানকার আদিবাসীদের চরম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়। মামলায় পড়ে সর্বস্বান্ত হন অনেকে। দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন অনেক আদিবাসী।

অসমাপ্ত যুদ্ধ : কিন্তু ভারতে জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের প্রভাবে প্রতিরোধযোদ্ধাদের শিবিরগুলো একে একে গুটিয়ে নিতে হয়। পাশাপাশি একই সময়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্নভাবে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরোধযোদ্ধাদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে কলাকোপা বান্দুরা এলাকায় সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয় বিশেষ আশ্রয়শিবির। একদিকে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সমর্থনের অভাব, অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্তহীনতার মুখে প্রতিরোধযুদ্ধ অসমাপ্ত অবস্থাতেই থেমে যায়। অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, প্রতিরোধযুদ্ধ ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তবে প্রতিরোধযুদ্ধের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও সাব-সেক্টরগুলোতে অবস্থান নেওয়া যোদ্ধাদের শেষ দলটি অস্ত্র ত্যাগ করেন ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে। সেই হিসাবে প্রতিরোধযুদ্ধের মূল সময়কাল দুই বছর।

৩৪ বছর পর আবেগঘন দেখা : ২২ থেকে ৩০ মাস চলে প্রতিরোধী গেরিলাযুদ্ধ। এরপর প্রতিরোধযোদ্ধারা একজন অপরজন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক আটক ও পুশব্যাক হয়ে আসা কয়েকশ’ যোদ্ধার ঠাঁই হয় সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রের বন্দীশালায়। অনেক যোদ্ধা নিরুদ্দেশ হয়ে যান আসাম-মেঘালয়ে। দীর্ঘ ৩৪ বছরেও তারা কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখারও সুযোগ পাননি। যুদ্ধে পরাজয়ের লজ্জা, গ্লানি আর ব্যর্থতার কারণে কেউ কারও খোঁজও করেননি। এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধানকালে সেই সব প্রতিরোধযুদ্ধের কমান্ডারদের একত্র করা হয় ভবানীপুর সেক্টর হেডকোয়ার্টার খ্যাত পাহাড়ি উপত্যকায়। অতিসম্প্রতি একত্র হয়ে ১৭ জন গেরিলা কমান্ডার একে অপরকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেকেই তখন চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।

সর্বশেষ খবর