শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
দাবিদার দুই ধর্মের দুই স্ত্রী

লাশ দুই বছর ধরে ফ্রিজে

মাহবুব মমতাজী

মৃত্যুর দুই বছরেও কবরস্থান কিংবা শ্মশানে জায়গা হয়নি ব্যবসায়ীর। কারণ তার লাশের দাবিদার ভিন্ন ধর্মের দুই স্ত্রী। এখনো পর্যন্ত ঢাকা জেলা জজ কোর্টে দেওয়ানি মামলায় ঝুলে আছে লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি। দুই নারীর লাশ দাবির বিষয়টি মীমাংসা না হওয়ায় স্বামী খোকন ওরফে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী ওরফে রাজীব চৌধুরীর লাশ প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পড়ে আছে। মৃত ব্যক্তি ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেটের মালিক। তার মৃত্যুর পর হাবিবা আক্তার খানম বাবলি নামে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষিকা এবং মীরা নন্দী নামে এক হিন্দু নারী তাকে নিজেদের স্বামী হিসেবে দাবি করেন। এ নিয়ে হস্তান্তরের জটিলতা দেখা দেওয়ায় লাশটি প্রথমে বারডেম হাসপাতালের মর্গে রাখা ছিল। পরে আদালতের এক আদেশে ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে সংরক্ষণের জন্য প্রিন্সিপাল বরাবর একটি চিঠি দেন বারডেম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মো. শহিদুল হক মল্লিক। লাশটি দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণে বর্তমানে মর্গের ডিপ ফ্রিজে ফেলে রাখা আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানায়, খোকনের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল মীরা নন্দী। একপর্যায়ে খোকন ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে হাবিবা আকতার খানমকে বিয়ে করেন। এখন দুই স্ত্রীই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী তাদের স্বামীর লাশ চাইছেন। কিন্তু খোকন হিন্দু না মুসলমান, তা নির্ধারণের জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৫ জুন অসুস্থতার কারণে প্রায় ৭০ বছর বয়সী খোকনকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ দিন পর ২৬ জুন তিনি মারা যান। মৃত্যুর ঘটনার পর লাশের দাবি নিয়ে দুই স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। পরে দুই স্ত্রীর দাবির পরিপ্র্রেক্ষিতে বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিরুপায় হয়ে রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের মর্গেই লাশটি সংরক্ষণ করে রাখে কিছুদিন। পরে হাবিবাও রমনা থানায় আরেকটি জিডি করেন। এরপর সেখান থেকে সিএমএম কোর্ট হয়ে ওই বছরের ২৩ অক্টোবর থেকে বিষয়টি নিয়ে সহকারী জজ আদালতে (দেওয়ানি ২৫২/১৪ ঢাকা) মামলা হয়। আদালতের আদেশে ১৫ নভেম্বর বারডেম থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ সূত্র জানায়, খোকনের দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতার খানম মুসলিম ধর্মানুযায়ী লাশ দাফন করতে চান। আর মুসলমান হিসেবে মারা গেলে দ্রুত লাশ দাফন করার নিয়ম। খোকন ১৯৮০ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হলফনামার মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তার নাম রাখা হয় রাজীব চৌধুরী। এরপর ১৯৮৪ সালের ১৫ জুলাই তিনি হাবিবা আকতারকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১৮ বছর রাজধানীর ৩৩১ নম্বর উত্তর শাহজাহানপুরে আতাউর রহমানের বাসায় হাবিবা-খোকনের সংসার জীবন কাটে। আর তাদের বিয়ের আগে মীরা নন্দীকে খোকন তালাক দিয়েছেন বলে দাবি করেন হাবিবা। আর হিন্দু নারী মীরা নন্দী বলছেন, খোকনের নাম খোকন নন্দী। খোকনের সঙ্গে ৫২ বছর সংসার চলেছে তার। তিনি জানিয়েছেন, খোকন হিন্দু, মুসলিম নন। তারা সনাতন হিন্দু ধর্ম মতে জীবনযাপন করতেন। 

রমনা থানার জিডির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা বর্তমানে শাহবাগ থানার অপারেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, ওই লাশটির মামলা এখনো ঝুলে আছে। তা নিয়ে জুডিশিয়ারি তদন্ত করা হচ্ছে। আসলে লাশটা এক সম্পত্তি। তাই জমি-জমার মামলা নিষ্পত্তি হতে যে সময় লাগে সেই সময় এখানেও লাগছে। কারণ লাশ কে পাবে তার জন্য অনেক প্রমাণ, কাগজপত্র ও দলিলাদি দেখানো এবং যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় আছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, লাশটি এখনো মর্গে আছে। কারণ বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যন্ত আদালতে নিষ্পত্তি হয়নি। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১০ সালে খিলগাঁওয়ে স্কুল শিক্ষক চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হলে তার লাশ নিয়েও দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। সে ঘটনায় সাড়ে তিন বছর মামলা চলার পর চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য হস্তান্তরের নির্দেশ দেন আদালত।

সর্বশেষ খবর