শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

টেনশন ২৫ পরিবার নিয়ে

অস্ত্র নিয়ে নিখোঁজ দুই ভাইয়ের ছবিতে তোলপাড়

মির্জা মেহেদী তমাল

টেনশন ২৫ পরিবার নিয়ে

পেছনে আইএসের পতাকা। পরনে তাদের কালো রঙের পোশাক। টেবিলে রাখা অস্ত্র। নিখোঁজ দুই ভাইসহ তিন যুবকের এমন ছবি প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে গোয়েন্দাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিখোঁজ ইব্রাহিম হাসান খান ও জুনায়েদ হোসেন খান নামের এই দুই ভাইয়ের ব্যাপারে গোয়েন্দাদের আগেই সন্দেহ ছিল। তাদের একজনের ফেসবুকের ওয়ালে এমন ছবি প্রকাশের পর গোয়েন্দারা নিশ্চিত যে, এরা এখন আর দেশে নেই। যোগ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থি সংগঠনে। একইভাবে টেনশন এখন নিখোঁজ ২৫ পরিবার নিয়ে। এদের বিষয়ে পুলিশের কাছে শতভাগ তথ্য না থাকলেও জুনায়েদ আর ইব্রাহিমসহ তিনজনের ছবি প্রকাশের পর নিখোঁজ এসব পরিবার গোয়েন্দাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর নিখোঁজ ১০ যুবকের যে প্রথম তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রকাশ করেছিল, সেখানে ওই দুই ভাইয়ের নাম আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়, ঢাকার ভাটারা থানা এলাকার বাসিন্দা এই দুই ভাই এবং তার পরিবারের সদস?্যরা প্রায় এক বছর ধরে নিরুদ্দেশ। তাদের ফেসবুকও ২০১৫ সালের জুনের পর হালনাগাদ হয়নি। বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে ইব্রাহিম হাসান খানের ফেসবুক পাতায় হঠাৎ ওই ছবি প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে তা সরিয়ে কিংবা গোপন করে ফেলা হয়। অবশ?্য ততক্ষণে ওই ছবির স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছেন অনেকেই। হলি আর্টিজানে হামলার সময় একই ধরনের ছবি প্রকাশ পেয়েছিল, যেখানে নিবরাসসহ হামলাকারী পাঁচজন ছিলেন সশস্ত্র অবস্থায়। নতুন করে যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনজনের মধ্যে সানগ্লাস পরা যে যুবককে দেখা যায়, তিনি ইব্রাহিম এবং তার পাশে লাল পাগড়ি পরা যুবক তার ভাই জুনায়েদ বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এদের পুরো পরিবার বছরখানেক আগে থেকে বাসায় নেই। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ইব্রাহিম ও জুনায়েদের বাবা মুনির হাসান খান সৌদি আরবে থাকতেন। এক বছরের বেশি সময় আগে একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তখন বাবা এবং তার দুই ছেলেকে একসঙ্গে অনেকেই দেখেছেন। মুনির দেখতে বেশ লম্বা। মুখে দাড়ি আছে। ছেলেরাও তার মতোই লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তারা বেশি দিন ঢাকায় থাকতেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুনায়েদ ও ইব্রাহিমের বিষয়ে তদন্ত জোরেশোরে চলছে। তারা কি দেশে, নাকি দেশের বাইরে রয়েছেন, তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে দেশে রয়েছেন এমন কোনো তথ্য এখনো গোয়েন্দাদের হাতে নেই। সূত্র জানায়, জঙ্গি নেতা তামিম ও তার বেশ কয়েকজন অনুসারী নিহত হলেও জঙ্গি তত্পরতা কমেনি। তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে। যারা দেশে নেই, তারা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, বা তাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেছেন।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন এই ছবি প্রকাশের পর এটা নিশ্চিত যে, যারা দেশ থেকে চলে গেছেন, তাদের অধিকাংশই উগ্রপন্থি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে নিখোঁজ রয়েছে এমন ২৫ পরিবার নিয়ে চিন্তিত গোয়েন্দারা।

ওই কর্মকর্তা জানান, ইয়েমেনি-আমেরিকান আল-কায়েদা নেতা আনওয়ার আল আওলাকির সঙ্গে দেখা করতে ২০১০ সালে ইয়েমেন গিয়েছিলেন পাঁচ বাংলাদেশি। তাদের দুজনের নাম রেজওয়ান শরিফ ও মইনুদ্দিন শরিফ। তারা দুই ভাই। তাদের বাবার নাম মৃত কাজী মোস্তাইন শরিফ। ঢাকার কাঁঠালবাগান এলাকায় তাদের বাড়ি। সেই সময় ইয়েমেনে ধরা পড়ার পর তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। একজন গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু এর পর থেকেই মা, বড় ভাই, ভাবীসহ তিনি নিখোঁজ। রেজওয়ান শরিফ ও মইনুদ্দিন শরিফ এখন কোথায় আছেন সেই খোঁজ চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এমন ২৫ পরিবারের তথ্য রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এরা দেশ থেকে চলে গেছেন। যোগ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থি সংগঠনে। এই পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, শরিফ পরিবারের চার সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। মইনুদ্দিন শরিফ (৩১), তার স্ত্রী তানিয়া শরিফ (২৫), ভাই রেজওয়ান শরিফ (২৯) ও মা পান্না শরিফ (৫২) প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ। কুয়াকাটায় বেড়ানোর কথা বলে তারা বাসা থেকে বের হন। তারা আর বাসায় ফিরে আসেননি। তবে নিখোঁজের ব্যাপারে কেউ পুলিশকে অবহিত করেনি। পান্না শরিফের ১১৫ ক্রিসেন্ট রোড কাঁঠালবাগানের আবেদা মঞ্জিলে কেউ নেই। ঢাকার পান্থপথের বাসিন্দা নিখোঁজ আশরাফ মোহাম্মদ ইসলামের পরিবারও নিখোঁজ। পান্থপথের ফ্ল্যাটে কেউ নেই। পুরো পরিবারই নিখোঁজ রয়েছে বছরখানেক ধরে। ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও প্রতিবেশীরা বলছেন, তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তারা কোথায় আছেন সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সূত্রমতে, গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ঢাকার এ কে এম তুরকিউর রহমান (পাসপোর্ট নম্বর-এএ ৪৩৬৯৭৮৩), তার স্ত্রী মিসেস রিদিতা রাহিলা ইকবাল (পাসপোর্ট নম্বর-এবি ৬৫৫৫৮০০) তাদের এক মাসের কন্যা রুমাইসা বিনতে তাকিকে (পাসপোর্ট নম্বর-বিসি-০৭১৯১৮২) নিয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তুরকিউর রহমান অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করার সময়ই মৌলবাদে দীক্ষা নেন এবং বাংলাদেশে এসে বিয়ে করে সপরিবারে সিরিয়ায় চলে যান। তার স্ত্রী ও কন্যার ওমরাহ পালন করে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল তুরস্কে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সায়মা আক্তার মুক্তা তার দুই সন্তান মো. আমান শেখ (৬), মো. রোমানসহ (৪) ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা থেকে গর্ভবতী অবস্থায় সিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সিরিয়ায় যাওয়ার কিছুদিন পর চতুর্থ সন্তান ওসমানের জন্ম দেন। বর্তমানে তারা সিরিয়ায় নিহত স্বামী মো. সিফুল হক সুজনের বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। বাংলাদেশে সায়মা আক্তার মুক্তার সর্বশেষ ঠিকানা ছিল ইকবাল নগর রোড, খুলনা (ইকবাল নগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে)। মুক্তার পাসপোর্ট নম্বর ‘এক্স-০১৪৮২০০’।

সর্বশেষ খবর