রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কলকাতায় ভোগান্তিতে বাংলাদেশিরা

হোটেল বিল খাওয়া-দাওয়া বন্ধ

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ক্যান্সারের রোগী রাজশাহীর নাসিমা ভর্তি হয়েছেন কলকাতার মুকুন্দপুরের এক হাসপাতালে। গতকাল তার এমআরআই করার কথা ছিল। কিন্তু রুপির সমস্যায় তা সম্ভব হয়নি। হাসাপাতাল থেকে বলা হয়েছে, রুপি জমা দিলে এমআরআই হবে, নইলে সম্ভব নয়। কিন্তু ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নেওয়া যাবে না। খুচরো দিন। নাসিমা বললেন, ‘নোট সমস্যার কারণে গতকাল রাতে পুরি খেয়েছি। কিন্তু আজ সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে থাকতে হয়েছে। আজকের মধ্যে রুপি জোগাড় করতে না পারলে কাল-পরশু বাড়ি চলে যাব।’ একই অবস্থা ৭ নভেম্বর ঢাকা থেকে কলকাতায় বেড়াতে যাওয়া রবিন চৌধুরীর। প্রথম দিনটা ভালো কাটলেও পরদিন থেকেই নোট সমস্যায় পড়েছেন তিনি। ৮ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ভারত সরকারের ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের ঘোষণা মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার। ভেবেছিলেন সবকিছু বোধহয় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু চার দিন পরও অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কী করবেন কূলকিনারা করতে পারছেন না তিনি। রুপি যা আছে এর প্রায় সবটাই ৫০০ ও ১০০০ হাজার রুপির নোট। মানি এক্সচেঞ্জগুলোও তা বদল করে দিচ্ছে না। ফলে সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। রুপির চিন্তায় দুবেলা দুমুঠো খাবার খেতে যাওয়ার আগে-পিছে চিন্তা করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ফুরফুরে মেজাজে দেশে ফেরার বদলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। রবিন বললেন, ‘প্রথমে হোটেলগুলো ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নিলেও এখন তারা বলছে এই রুপি চলবে না। এ অবস্থায় কোথাও খেতে পারছি না, ঘুরতে পারছি না। বিপদে পড়ে গেছি। যদিও পুলিশ বলেছে, হোটেল কর্তৃপক্ষ রুপি নিতে বাধ্য। এমনকি মানি এক্সচেঞ্জগুলোও রুপি নিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা তা শুনছে না। এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি।’ এ সংকট শুধু নাসিমা ও রবিনের নয়। ভারতে হঠাৎ ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করার ঘোষণায় কলকাতায় চিকিৎসা, বেড়ানোসহ নানা কাজে যাওয়া কয়েক হাজার বাংলাদেশি পড়েছেন অশেষ ভোগান্তিতে। হঠাৎ করে বড় নোট বাতিলের ঘোষণায় পুরো কলকাতাতেই দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সংকট। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রুপি। হোটেল বিল, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে রোগীর চিকিৎসা, অপারেশনও। বাংলাদেশ থেকে আসা প্রত্যেকেরই এখন শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। না পারছেন কলকাতায় থেকে যেতে, না পারছেন দেশে ফিরে যেতে। বাংলাদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগই কলকাতায় যান চিকিৎসা করাতে। প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ বাংলাদেশি ভারতে গিয়ে থাকেন। সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া পর্যটকদের বেশির ভাগই নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন হোটেলে থাকেন। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেই তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রত্যেকেই। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ। হাতে গোনা কয়েকটি খোলা। কিন্তু সেখানেও রুপির জোগান নেই। এমনই একটি বন্ধ মানি একচেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘আমার বন্ধুর অপারেশনের জন্য কলকাতা এসেছি। কিন্তু এখানে রুপি তো নিচ্ছেই না, এমনকি দেশ থেকে ডলার নিয়ে আসা হয়েছে তাও নিচ্ছে না। হাজার হাজার বাঙালি না-খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। হাজার রুপি দিয়ে ৩০০ রুপি চাইছে কেউ কেউ। কিন্তু তাও পাওয়া যাচ্ছে না। এতটাই অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি। মানুষের ভোগান্তির আর শেষ নেই এখানে। খাবার, কেনাকাটাও করতে পারছি না। হোটেলগুলোও কোনো নোট নিচ্ছে না। এখন আমরা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার মতো রুপিরও সংকট দেখা দিয়েছে। যেভাবে হোক হাত-পায়ে ধরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

খাবারের ক্ষেত্রেও জটিল সমস্যায় পর্যটকরা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে খুচরো রুপি দিলে খাবার দেওয়া হচ্ছে। আর খুচরো না থাকলে খালিপেটেই বেরিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। কস্তুরী রেস্তোরাঁর ম্যানেজার রশিদ আলম মালিক বলেন, ‘নোট বাতিলের ফলে আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষ যেমন সমস্যায় পড়েছি, ঠিক তেমনি হোটেলের পর্যটকরাও সমস্যায় পড়েছেন। কারণ তাদের হাতে খুচরো থাকে না। সবটাই ৫০০ ও হাজার রুপির নোট। আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসছে। কিন্তু আমরাও নিরুপায়। কারণ সেই রুপি নিয়ে কী করব!’

সমস্যায় পড়েছেন যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী কিংবা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গের নামি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়তে আসে। কলকাতার বিভিন্ন হোস্টেলে থেকে তারা পড়াশোনা করে। একই সমস্যা পেট্রাপোল-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্তেও। ব্যাপক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আগত যাত্রীদের। অবশ্য নোট সমস্যার কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যাও কিছুটা কমেছে। নোট সমস্যায় যে কেবল পর্যটকরাই হয়রানির শিকার হয়েছেন তা নয়। নিউমার্কেটের হোটেলগুলোর ব্যবসাও চরম মার খাচ্ছে। আগে যে সংখ্যায় অতিথিরা আসতেন, এখন অর্ধেকও আসছেন না।

 

পর্যটকদের পাশাপাশি ভারতীয়দেরও দুর্ভোগের শেষ নেই। শনিবার ছুটির দিনও এটিএমগুলোতে চরম বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি কথা রাখতে পারেনি বেসরকারি ব্যাংকগুলোও। কারণ নগদ জোগানের অভাব। বাইরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর এটিএমে রুপির জোগান শেষ হয়ে যাওয়ায় খালিহাতে ফিরতে হয়েছে অনেককে। উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি মহম্মদ আমিন নামে এক ব্যক্তি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আজ রবিবার ছুটির দিনও ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। যদিও তাতে গ্রাহকরা কতটা স্বস্তি পাবেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

ভারতের রাজনীতিতেও উত্তাপ : নোট বাতিল নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে ক্রমশ সুর চড়াচ্ছেন মমতা। শনিবার বিকালেই নবান্নে সংবাদ সম্মেলন করে মমতা অভিযোগ জানান, ‘মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ জালিয়াতি করা হয়েছে। যারা কালো রুপির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। এটা খুবই ভয়ানক, এটা ডিজাস্টার। এ সিদ্ধান্তের জন্য সাধারণ মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, জনগণকে ভাতে মেরেছেন মোদিজি। সাধারণ মানুষকে কাঁদিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে চলে গেলেন আর সেখানে গিয়ে জ্ঞানের বাণী শোনাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে হুমকি দিয়ে বলছেন, ৩১ ডিসেম্বরের পর দেখে নেবেন। তিনি কি সাধারণ মানুষের ওপর সেনা দিয়ে গুলি চালাবেন? এটা কখনো একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে না। দেশকে বাঁচাতে, জরুরি অবস্থা থেকে বাঁচাতে প্রতিটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের এর বিরুদ্ধে সরব হওয়া উচিত।’ এর আগে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ দেখতে এদিন দুপুরের দিকে কলকাতার ব্যাংক ও এটিএম পরিদর্শনে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা মুখার্জি। প্রথমে শরৎ বোস রোডের একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং পরে আশুতোষ মুখার্জি রোডে একটি বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে যান মুখ্যমন্ত্রী। ওই তিনটি ব্যাংক-সংলগ্ন এটিএম পরিদর্শন করেন এবং লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাহকদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে লাইনে দাঁড়ানোর অপেক্ষা ও খুচরো সমস্যা নিয়ে অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। টুইটেও মোদিকে তোপ দেগে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

ভোগান্তি সীমান্ত বন্দরগুলোয় : ভারতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের ব্যবহার করা স্থলসীমান্তগুলোয় ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের তীব্র প্রভাব পড়েছে। ভারতগামীরা পড়েছেন সংকটে। সিলেটের তামাবিল, যশোরের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, লালমনিরহাটের বুড়িমাড়ী, দিনাজপুরের হিলিতে আমদানি-রপ্তানিকারক ও পর্যটকরা প্রয়োজনীয় রুপি পাচ্ছেন না। আবার অনেকে ভারতে যাওয়ার পর বদলে নেওয়া ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নিয়ে দেশে ফিরছেন। তারাও আর সেগুলোকে টাকায় পরিণত করতে পারছেন না।

সর্বশেষ খবর