“ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ‘ম্যাজিকম্যান’। তিনি কখন যে কী করেন তা বলা মুশকিল। ট্রাম্প কী ম্যাজিক দেখান আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এর আগে ট্রাম্পের মতো কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সাধারণের মধ্যে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি তার মতো কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীও আগে সাধারণের মূল্যবোধ এভাবে ধ্বংস করেননি। তবে ধারণা করছি, ট্রাম্পের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আর তার মধ্যে পরিবর্তন এলে অনেকের উপকার হবে। যদি ট্রাম্পের চিন্তাধারায় ও কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন না আসে তাহলে আমেরিকানরা তাকে সাদরে গ্রহণ করবেন না বলেই ধারণা করছি।” জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদ্য সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. এ কে আবদুল মোমেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব বলেন। ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, “ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় যেসব বক্তব্য রেখেছিলেন সেগুলো আমেরিকার যুগ যুগ ধরে লালিত আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। আমেরিকার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তার আছে স্বচ্ছ রীতিনীতি, আইন-কানুন ও উন্নতমানের আদর্শ। সেই আদর্শের জন্যই সারা বিশ্বের অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষেরা দেশটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা মনে করে এটিই হবে তাদের শেষ আশ্রয়। কিন্তু এবার নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের বক্তব্যে সারা বিশ্বের সেই অসহায় মানুষগুলোর আশা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার বৃহত্তর জনগণ তাদের দীর্ঘদিনের লালিত আদর্শে বিশ্বাসী। আর এ আদর্শ ভাঙার ফলে তারা যথার্থভাবেই অসন্তুষ্ট। এরপর ট্রাম্প একজন রিপাবলিকান হয়েও রিপাবলিকানরা যেসব ধারণায় বিশ্বাসী যেমন— মুক্তবাণিজ্য, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যাটো ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছেন। এমনকি রিপাবলিকানরা সব সময় অভিবাসীদের বড় ধরনের সাপোর্টার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণাকালে এ বিষয়গুলো ট্রাম্প তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। এসব কারণে সাধারণ মানুষ এমনকি রিপাবলিকানদের মধ্যেও তাকে নিয়ে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়। বৃহত্তর জনগণ ট্রাম্পের প্রতি অসন্তুষ্ট কারণ তাদের নৈতিক মূল্যবোধের জায়গায় ট্রাম্প আঘাত হেনেছেন। আর ট্রাম্প জয়লাভ করেছেন একটি বড় জোয়ার তুলে। তা হলো, ‘আমেরিকাকে বাঁচাও’, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। ডোনাল্ড জিতেছেন ভালো। কিন্তু তিনি কতদিন টিকবেন, তা জানি না।” জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদ্য সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ট্রাম্পকে আরও কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে ট্রাম্প তার একটি কমিটির কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। এ কাঠামোয় কে কোন দায়িত্ব পালন করবেন বা কোন পদ পাবেন তা নির্ধারণ করা নিয়ে তিনি এখন ব্যস্ত থাকবেন। এর ফাঁকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে কী দায়িত্ব পালন করবেন, তা তাকে বোঝানো হবে। এজন্য কোন এজেন্সি কী কাজ করে সে বিষয়ে তিনি শিক্ষা নেবেন। ড. মোমেন আরও বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদের জন্য যে দুজনের নাম এসেছে এদের একজন জিনগ্রিচ, আরেকজন বলটন— দুজনকে চিনি। এরা দুজনই চরম ডানপন্থি। তারা যদি প্রশাসনে থাকেন ভয়ের কারণ আছে। তবে ট্রাম্পের মধ্যে পরিবর্তন ঘটলে অনেকের উপকার হবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে দুটি ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনা আছে। এশিয়াকেন্দ্রিক যে বাণিজ্য ওবামা করছিলেন সেখানে আমাদের পোশাক খাতের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া।
এ দেশগুলো থেকে সস্তায় পণ্য আনার জন্য কোড অব এক্সেস টু মার্কেটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওবামা প্রশাসন। ট্রাম্প তা বাতিল করবেন বলে ধারণা করছি। বাতিল হলে আমরা লাভবান হব। তবে জলবায়ুর ক্ষেত্রে ট্রাম্প বলছেন, তিনি এ বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্মত নন; সে ক্ষেত্রে আমাদের শঙ্কা আমরা সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হব। এ ছাড়া চীন ও মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় পণ্য আমদানিতে যথাক্রমে ৪০ ও ৩৫ শতাংশ ট্যারিফ বসানোর কথা বলেছেন ট্রাম্প। আর এসব দেশে বেশি ট্যারিফ বসালে আমাদের দেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেশি বিক্রি হবে। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ট্রাম্প সহজলভ্য মেডিসিন দেওয়ার কথা বলেছেন। তখন হয়তো বাংলাদেশ সেখানে ওষুধ রপ্তানিরও সুযোগ পাবে। তবে আশঙ্কার বিষয় এই যে, সেখানে যে ১২ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী আছেন তাদের ১ মিলিয়নকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই তিনি বের করে দেওয়ার কথা বলেছেন। আবার ট্রাম্প বলছেন যে, তিনি ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো অর্থাৎ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করবেন কিন্তু এ কাজগুলো করতে গেলেও ট্রাম্পের লোক লাগবে। সে ক্ষেত্রে অভিবাসীরা কাজের সুযোগ পেতেও পারেন। এ ছাড়া করপোরেট ট্যাক্স ৩৫% থেকে ১৫%-এ নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে করপোরেশন অনেক টাকা পাবে যা দিয়ে তারা বিনিয়োগ করতে পারবেন আর ব্যক্তিগত ট্যাক্স ৫% কমানোর কথাও বলেছেন। আর জিনিসের ওপর ট্যারিফ বসালে এর দাম বৃদ্ধি পাবে। তখন ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া এক ধরনের গোলক-ধাঁধা তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার ট্রাম্পকে সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসার জন্য যে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে তা খুবই স্মার্ট প্রস্তাব।’
ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ এখন রাস্তায় নেমে ট্রাম্পবিরোধী যে আন্দোলন করছেন তা থেকে অবশ্যই তারা কিছু পাবেন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে বহু জায়গা থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকার মূল্যবোধ নষ্ট করার জন্য মামলা হতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্সি তিনি পেয়েছেন। আরেকটি হচ্ছে কংগ্রেস ও সিনেট। কংগ্রেস তিনি পেয়েছেন। দুটি ক্ষমতা তার হাতে। তার তৃতীয়টি হচ্ছে জুডিশিয়ারি। ধারণা করছি জুডিশিয়ারিও তিনি ভালোভাবে সামলাতে পারবেন। কিন্তু ট্রাম্প অন্যায় কাজ করলে রিপাবলিকানরা তার বিরুদ্ধে যাবেন। এজন্য তাকে তার কাজে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন শুরু করেছেন তা যদি আরও জোরদার হয় এবং তাদের যদি শান্ত করার ব্যবস্থা করা না যায় এবং এই আন্দোলন মাসব্যাপী হয় তবে আমেরিকার সরকারের পক্ষে এটি সামলানো কষ্টকর হয়ে যাবে। তবে আমি মনে করছি না এ আন্দোলন তিন-চার দিন পর বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ মানুষ মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে।’