শিরোনাম
শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
সব দলের মত নিতে হবে : খালেদা

এবার ইসি নিয়ে বির্তক

♦ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব
♦ কমিশন গঠনে ১৩ দফা
♦ সার্চ কমিটি ৫ সদস্যের
♦ নারীসহ ৪ জন কমিশনার

নিজস্ব প্রতিবেদক

এবার ইসি নিয়ে বির্তক

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সাবেক বিচারপতি, সচিব ও শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বা নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করতে এ প্রস্তাব দেন তিনি। সব দলের ঐক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়ে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সৎ, সাহসী, অবাধ ও সুষ্ঠু স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। কারণ নির্বাচনকালীন প্রশাসন যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।’ গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানান বিএনপি প্রধান। পৌনে এক ঘণ্টার লিখিত বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের রূপরেখাসহ বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি ‘সহায়ক’ সরকার গঠনের প্রয়োজনের কথাও উল্লেখ করেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পরবর্তীকালে বিস্তারিত প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। ১৩ দফা প্রস্তাবনায় নির্বাচন কমিশন নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের একটি রূপরেখা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কয়েকটি ধারা সংশোধনের কথাও উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতার কথা বর্ণনা করে বেগম খালেদা জিয়া একজন নারীসহ চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের হতে হবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও দলনিরপেক্ষ। বাছাই কমিটির কাছে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে দুজন করে নাম প্রস্তাব করতে পারবে। সেখান থেকে বাছাই কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে চূড়ান্ত মনোনয়নের পর কেউ যদি দায়িত্ব পালন করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন, তবে একই প্রক্রিয়ায় আবারও বাছাই করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতাদের মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.), ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, মেজর জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী (অব.), অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমদ আজম খান প্রমুখ অংশ নেন।  ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কর্নেল অলি আহমদ (অব.), টিআইএম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, শফিউল আলম প্রধান, মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (অব.) বীরপ্রতীক, জেবেল রহমান গানি, খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মহিউদ্দিন ইকরাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোস্তাহিদুর রহমানসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচন কমিশন গঠন এবং তা শক্তিশালীকরণের প্রস্তাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করারও দাবি জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আঠারো বছর বয়সী সব নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রবাসীদেরও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনকালীন প্রশাসন যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে সে জন্য ইসিকে কঠোর ভূমিকা পালনের কথা উল্লেখ করে তিনি ভোটার তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ ও  ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট নিয়োগসহ নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা পর্যন্ত সবকিছুই বর্ণনা করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় খালেদা জিয়া বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে (২০১৭) বর্তমান বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন— নিঃসন্দেহে তাদের নিরপেক্ষতা, যোগ্যতা এবং দায়িত্ব পালনের দৃঢ়তা প্রশ্নাতীত হতে হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং ভোটাররাই শুধু নয়, সারা বিশ্ব যে কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে প্রশংসা কিংবা তিরস্কার করে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে বিশেষ করে গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে এবং গত কয়েক বছরের অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে হতাশ, আস্থাহীন এবং ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বৃহত্তর জাতীয় ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এহেন পরিস্থিতি আর চলতে দেওয়া যায় না। জনগণ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন চান।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে বেগম জিয়া তার প্রস্তাবনায় ১৩ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিরূপণের জন্য সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব রাজনৈতিক দলের মহাসচিব অথবা সাধারণ সম্পাদক কিংবা মনোনীত প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পৃথকভাবে বৈঠকের কথা বলেন তিনি। তবে দেশে যেহেতু এই মুহূর্তে ২(দুই)টি প্রধান রাজনৈতিক জোট (বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিদ্যমান) সেহেতু এই দুই জোটের পক্ষ থেকে একজন করে মূল প্রতিনিধি এবং তাকে সহায়তাদানকারী আরও দুজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে সৎ, যোগ্য ও দল নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদেরও আলোচনায় যুক্ত করতে পারেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ও মনোনয়নের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধনকৃত উল্লিখিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাছাই বা সার্চ কমিটি গঠন প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই বা সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে ৫ (পাঁচ) সদস্যবিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন তিনি। বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি (জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে) যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত নন এবং ছিলেন না এমন একজনের নেতৃত্বে এই বাছাই কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত নন বা ছিলেন না। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সৎ এবং দল নিরপেক্ষ একজন সচিব যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না। তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কোনো কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন নারীসহ সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, মেধাবী, দক্ষ, প্রাজ্ঞ, সাহসী, নৈতিকতাসম্পন্ন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও কর্ম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও সকল বিচারে দলনিরপেক্ষ এবং বিতর্কিত নন এমন ব্যক্তিদের মধ্য হতে চারজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হতে পারবেন। তাদের যোগ্যতা হবে ন্যূনতম পক্ষে জেলা জজের মর্যাদাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা, ন্যূনপক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, ন্যূনপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট কোনো নাগরিক। তবে যিনি প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের কোনো চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ বা পদত্যাগের বা অপসারণের পর কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ সমাপ্তি বা চুক্তি বাতিলের পর, তিন বছর সময়কাল অতিবাহিত করেননি তিনি নির্বাচন কমিশনার পদে পদায়নের যোগ্য হবেন না।  প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চূড়ান্তকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ সম্মত না হলে, কিংবা অন্য কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে, বাছাই কমিটি কর্তৃক মনোনীত অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য হতে রাষ্ট্রপতি একই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে চূড়ান্ত নিয়োগ প্রদান করবেন।

সর্বশেষ খবর