বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সজাগ আওয়ামী লীগ, মাঠ ছাড়বে না বিএনপি

বিদায়ী ইসির শেষ পরীক্ষা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সজাগ আওয়ামী লীগ, মাঠ ছাড়বে না বিএনপি

নারায়ণগঞ্জে গতকাল সতর্ক প্রহরায় বিজিবি, তল্লাশিতে র‌্যাব ও ভোটের সরঞ্জাম সরবরাহে ব্যস্ততা কর্মীদের —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে সজাগ দৃষ্টি রাখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় নিজ নিজ অফিসে বসে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। আওয়ামী লীগ ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে আর বিএনপি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ভোট গ্রহণ পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখবে। শুরু থেকে ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত খোঁজখবর রাখবে দুই দল। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাত্ক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দুই দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, আজ ভোট গ্রহণ শুরু থেকেই নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়ক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করবেন। তারা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা এবং দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে সার্বিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। এর মধ্যে নির্বাচনের পরিস্থিতি তুলে ধরে এক থেকে দুই দফা সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হবেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এ ব্যাপারে গতকাল বিকালে এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের খোঁজখবর নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সার্বিক খোঁজখবর রাখবেন তিনি নিজেও। দলীয় সূত্রমতে, জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনকে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। সেজন্য জয়-পরাজয় যাই হোক, একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিতে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকালে ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপিকে কোনো ধরনের আন্দোলনের ইস্যু দেবে না আওয়ামী লীগ। নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা হবে, যাতে বিএনপি কোনো ধরনের আন্দোলনের সুযোগ না পায়। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। কোনো অবস্থাতেই বিএনপি যেন একে আন্দোলনের ইস্যু হিসেবে দাঁড় করাতে না পারে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নির্বাচন মনিটর করা হবে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায় নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেবেন। নারায়ণগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা যোগাযোগ রাখবেন। নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের মতো মধ্যরাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে বিরত থাকার মতো ঘটনা চান না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তা মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল বিকালে দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী দলের নয়াপল্টন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপি এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করবে না। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ভোটবিপ্লব ঘটবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পক্ষে গণরায় দেবে নারায়ণগঞ্জবাসী। কোনো বাধায় ধানের শীষের জোয়ার ঠেকানো যাবে না।

বিদায়ী ইসির শেষ পরীক্ষা : বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের শেষ পরীক্ষা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের দিকেই এখন সবার দৃষ্টি। প্রধান দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। কমিশনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে এ নির্বাচনকে। তারা বলছে, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মাধ?্যমে দলগুলোর মধ্যে ‘গভীর আশা’র সৃষ্টি হবে। এ জন্য ‘অবিস্মরণীয়’ নির্বাচন উপহারও দিতে চায় ইসি। যদিও আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ের আগে এ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে অনেকটাই চিন্তায় রয়েছে তারাও। তাই ইসি সচিবালয় থেকে সরাসরি মনিটর করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনাররা। দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি-অনিয়মের অভিযোগের পর এই সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা ইসির শেষ পরীক্ষা বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক উত্তাপে সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিরোধ, বর্জন, গোলযোগ ও দখলের অভিযোগের মধ্যে সমালোচনার মুখেও পড়ে দেশে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এই কমিশন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে যে সহিংসতা দেখা দিয়েছিল, এ ধরনের কোনো শঙ্কা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে সৃষ্টি হয়নি। ভোটের প্রচারণার পরিবেশও ছিল সৌহার্দ?পূর্ণ। ভয়ভীতি, হুমকি, বাধা দেওয়ার ঘটনাও নেই এ ভোটের আগে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ (সিইসি) ১৫ ডিসেম্বর প্রার্থী, ভোটার ও দলগুলোর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা আশ্বস্ত হোন, একটিমাত্র নির্বাচন হচ্ছে, সারা দেশে আর কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। আমি আশাবাদী আপনারা ইচ্ছা করলেই এ নির্বাচনকে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন।’ এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সব নির্বাচনকে সমানভাবে দেখি। কোনো নির্বাচন শেষ নির্বাচন নয়। বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচনকে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ করার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ইসির এটা শেষ নির্বাচন। ভালো নির্বাচন করতে কমিশন আন্তরিক। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে অবশ্যই। যারা ভায়োলেন্স করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা হবে।’ এ নির্বাচনের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে কারও কাছ থেকে অভিযোগ আসেনি। দল ও তাদের প্রার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। গণমাধ্যমেও তারা পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দলীয়ভাবে প্রথম সিটি নির্বাচন করাকে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনটা আমাদের কাছে চ?্যালেঞ্জ। এ জন্য সুন্দর ভোট আয়োজনে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ নেই কারও। আশা করি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও একটা ভালো নির্বাচন দেখবে আশা করি।’ এদিকে মঙ্গলবার বিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস?্য নজরুল ইসলাম খান জানান, এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটেনি। কোনো বাধারও সৃষ্টি হয়নি। শঙ্কার কথা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ইসির বিদায়ের আগে একটি ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করছি আমরা। ইসিও আপ্রাণ চেষ্টার কথা জানিয়েছে। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই।’ বিএনপি নির্বাচন নিয়ে এযাবৎ কোনো অভিযোগ করেনি উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের দল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে এটাই আমরা চাই। এটাই আমাদের নেত্রীর নির্দেশ।’

অভিযোগ ১০০, জরিমানা ২৫ জনকে : নারায়ণগঞ্জের ভোটে সাত মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসেনি বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা নুরুজ্জামান। ভোটে থাকা কাউন্সিলরদের মধ্যে ১৫৬ জন সাধারণ ও ৩৮ জন সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ১০০ জনের বিষয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেককে সতর্ক করেছি। ২৫ জনকে জরিমানা করেছেন নির্বাহী হাকিমরা। কোথাও কোনো বাধা-হামলার ঘটনা ঘটেনি। নির্বিঘ্নে যাতে মানুষ ভোট দিতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত রাখতে মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে ৯ হাজার সদস্য, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম। ভোট পর্যবেক্ষণে কয়েক হাজার সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক থাকবেন।’ রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, প্রচারণা শেষ। এখন ভোটের অপেক্ষা।

সর্বশেষ খবর