সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায় কার?

পরিমার্জনে কমিটি গঠন

আকতারুজ্জামান

পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে চলছে নানা কথা। সবাই বলছেন পাঠ্যবই নিয়ে এমন ভুল অতীতে আর কখনো হয়নি। এদিকে শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের সমালোচনার পর পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু কমিটি গঠন করলেও ভুলের দায় স্বীকার করছেন না কেউ। গতকাল এনসিটিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সদস্য  বলেছেন, প্যাডালজিক্যাল (শিক্ষাতত্ত্বের) দিক থেকে গাছের ওপর ছাগলের ছবি ভুল নয়। পাঠ্যবইয়ে নানা ভুলের সঙ্গে কারা জড়িত ছিলেন তা জানতে তথ্য অধিকার আইনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে মেহেদী হাসান নামে এক যুবক লিখিত আবেদন করেছেন। নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। জানা গেছে, পাঠ্যবইয়ের অধিকাংশ ভুলগুলো হয়েছে প্রাথমিক শ্রেণির বইগুলোকে ঘিরে। এসব বই দেখভালসহ রিভিউ করার দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষাক্রম শাখার। গতকাল এনসিটিবির বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে এসব ভুলের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এসব ভুলই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। ‘গাছের ওপর কীভাবে ছাগল তুলে দেওয়া হলো এমন কথোপকথনের এক পর্যায়ে আবদুল মান্নান বলেছেন ফ্যান্টাসির (কল্পনা) মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এসব জ্ঞান আহরণ করবে। আনন্দ পাবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির কাছে দায়সারা এমন জবাব পেয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তারা আর কথা বাড়াননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ছাগল কখনো আমগাছে উঠবে না। এটি মিথ্যা। আনন্দের জন্য কল্পলোকে বিচরণ করা যায়। কিন্তু মিথ্যালোকে বিচরণ করা যায় না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ প্রতিবেদক গাছের ওপর ছাগলের ছবি ব্যবহারের বিষয়টি জানতে চাইলেও এ ছবি ব্যবহার সঠিক বলে জানান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘প্যাডালজিক্যাল (শিক্ষাতত্ত্ব) দিক থেকে এর ব্যবহার সঠিক। তবে অনেকের ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে’। তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, যেসব ভুল নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সেগুলো ছাড়াও নতুন শিক্ষাবর্ষের সব বই পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পেলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব ভুল-ত্রুটি ঠিক করে সংশোধনী শিট দেওয়ার কথা জানান তিনি। নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির এক সদস্য বলেন, এমন ভুলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে গণমাধ্যম মারফত। ভুলের সংশোধনী এসব বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, ভুল সংশোধন করে বই বা শিট আকারে দূরবর্তী এলাকাগুলোতে পাঠানো অনেকটাই অসম্ভব। এদিকে ভুল পাঠ্যবই দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা আর সংশয় বাড়ছে দিন দিন। জীবনের প্রথম বই হাতে নিয়ে শিশুরা ভুল শিখছে এমন মন্তব্য করেছেন অনেক অভিভাবকই। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ফোন করে এসব সংশয়ের কথা জানাচ্ছেন। ভুল সংশোধনে গঠিত এনসিটিবির পর্যালোচনা কমিটির অগ্রগতি জানতে আহ্বায়ক কাজী আবুল কালামের কক্ষে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে দফায় দফায় কল ও মেসেজ দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, বছরের প্রথম দিন সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয় সরকার। এসবের মধ্যে প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে লেখা হয়েছে, ‘ও’-তে ওড়না চাই। যা নিয়ে ফেসবুকে চলছে তুমুল সমালোচনা। এক সময় অ-তে অজগর শেখানো হলেও তার বদলে শিশুদের বইয়ে অপ্রচলিত ‘অজ’ (ছাগল) শব্দের ব?্যবহার সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার আম খাওয়া বোঝাতে একটি আম গাছের নিচের অংশে দুই পা তুলে একটি ছাগলের দাঁড়িয়ে থাকায় ছবি দেওয়া হয়েছে। আবার একটি বর্ণের পরিচয়ের ক্ষেত্রে গাছের ওপর ছাগল তুলে দেওয়া হয়েছে। এই ছবি নিয়ে অনেকেই ফেসবুকে করেছেন সমালোচনা। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, এনসিটিবির হঠাৎ ছাগলপ্রীতির কারণ কী তা আমার মাথায় আসছে না। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির নিচে ইংরেজিতে একটি বাক্য লেখা হয়েছে ভুল বানানে। ওই বাক্যে আঘাত করা বোঝাতে গিয়ে হার্ট-এর ভুল বানান লেখা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় বেশ কয়েটি লাইন বিকৃত করার কথা জানিয়ে ফেসবুকে তারও সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ।

মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম পর্যালোচনায় দুই কমিটি : শিক্ষাবিদদের সুপারিশের ভিত্তিতে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করে পাঠ্যপুস্তক আরও সুখপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজ করতে দুটি কমিটি করেছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সুপারিশের ভিত্তিতে এই কমিটি দুটি করা হয়। এক কমিটি পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করে পাঠযোগ্য করতে সুপারিশ দেবে। আরেক কমিটিকে নবম-দশম শ্রেণির কয়েকটি বই পরিমার্জন করে সুখপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যবই সহজ করতে গঠিত কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনজুর আহমদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, মতিঝিল সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক তানজীল আশ্রাফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহাও এই কমিটির সদস্য। এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান সদস্য সচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমদ কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই কমিটিকে আগামী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিদ্যমান পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন ও পরিমার্জনের বিষয়ে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির নির্বাচিত কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করে সুখপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজ করার লক্ষ্যে গঠিত অপর কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও অধ্যাপক এম এম আকাশ এবং বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম, উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান, এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহাকেও এই কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ইনামুল হক সিদ্দিকীকে এই কমিটির সদস্য সচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমদকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর